Sunday, April 29, 2018

সুন্দরবনঃ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সম্পর্কে কিছু তথ্য - ১৭

সুন্দরবনের বৃক্ষরাজি

সুন্দরবনের প্রধান বৃক্ষ হল সুন্দরী ও গেওয়া। সুন্দরবনের গাছপালা সমুদ্রের লোনা পানি ও উপরের মিঠা পানির সংমিশ্রনে গড়ে উঠেছে। সুন্দরবন বিভিন্ন উদ্ভিদ রাজিতে পরিপূর্ণ। সুন্দরবনকে লবন ভুমির বন বলা হয়। এ বন আর্দ্র বন। সুন্দরবনে মোট ৩৩৪ প্রজাতির গাছ গাছরা আছে। এ বনের প্রধান প্রধান গাছপালা হল- সুন্দরী, গেওয়া, গরাণ, গোলপাতা, কেওড়া, বাইন, পশুর, কাকড়া, সিংড়া, আমুর, ধুন্দুল। সবচেয়ে মজার কথা হল সুন্দরবনের যত পশ্চিম দিকে যাওয়া যায় গাছের উচ্চতা তত ছোট দেখায়। আর যত পুর্ব দিকে যাওয়া যায় গাছের উচ্চতা তত বড় দেখা যায়। তেমনি সুন্দরবনের দক্ষিন দিকের গাছ ছোট ও উত্তর দিকের গাছ বড় হয়। সুন্দরবনের পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকের পানির লবণাক্ততা বেশি এবং পুর্ব ও উত্তর দিকে লবনাক্ততা কম। তাই সুন্দরবনের পশ্চিম অংশে সাতক্ষীরা রেঞ্জে গরাণ ও গেওয়া বণ বেশি। আর পুর্ব অংশে খুলনা, চাঁদপাই ও শরনখোলা রেঞ্জে সুন্দরী ও গেওয়া বেশি। সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রজাতির গাছ স্তরে স্তরে দেখা যায়। নদীর পাড় হতে এসব গাছপালা অবলোকন করলে দেখা যায় প্রথমে নদীর পাড়ে গোলপাতা গড়ে উঠেছে। তারপর পর্যায়ক্রমে বনের ভিতর দিকে গেওয়া, বাইন ও সুন্দরী দেখা যায়। গেওয়া, বাইন ও সুন্দরী প্রাকৃতিক ভাবে সাজানো। এ অপরূপ দৃশ্য দেখলে মনে এক অনাবিল আনন্দের অনুভুতি জোগায়। এসব গাছপালা কোথাও একক ভাবে আবার কোথাও মিশ্রভাবে গড়ে উঠেছে। সুন্দরবনে সবচেয়ে বেশি গাছ আছে সুন্দরী। তারপর গেওয়া, গরাণ ও গোলপাতা। সুন্দরবনে গাছ লাগিয়ে বন তৈরী করা হয় না। গাছ হতে মাটিতে ফল পড়ে প্রাকৃতিক ভাবে বন সৃষ্টি হয়। এর ফলে সুন্দরবনে বন তৈরীতে কোন মূলধন ও পরিচর্যার দরকার হয় না। যুগ যুগ ধরে সুন্দরবন হতে গাছ কাটা হচ্ছে। আর এমনিতেই খালি জায়গায় গাছ জম্মাচ্ছে। সুন্দরবনের মাটির উর্বরতা সব জায়গায় সমান নয়। জায়গার উর্বরতা অনুযায়ী সুন্দরবনকে চার শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। সুন্দরী, গেওয়া, পশুর ইত্যাদি গাছ অতি ধীরে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়। তাই সুন্দরী, গেওয়া ও পশুর গাছ কাটার উপযুক্ত সময় ১০৪ – ১৩৫ বছর।

সুন্দরী গাছ

যে বৃক্ষের নাম অনুসারে সুন্দরবনের নাম হয়েছে বলে ধারণা করা হয় সে সুন্দরী বৃক্ষ সুন্দরবনের প্রধান ও আকর্ষণীয় বৃক্ষ। সুন্দরী বৃক্ষের শারীরিক গঠন, উচ্চতা, বেড়, গায়ের রং, জীবনধারণ ও কাঠের ব্যবহার সব মিলিয়ে এটি একটি সুন্দরবনের যে প্রথান বৃক্ষ তা প্রমান করে। সুন্দরবনে পশুদের রাজা যেমন বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার তেমনি গাছের রাজা সুন্দরী। বনের দিকে তাকালে সবুজ ও পিংগল বর্নের পাতা সহ সুউচ্চ যে গাছপালা দেখা যায় সেগুলো সুন্দরী বৃক্ষ। সুন্দরী বৃক্ষ বনের মধ্যে মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে। দেখলে খুব সুন্দর লাগে। একটি সুন্দরীবৃক্ষ সাধারণত ২০-২৫ মিটার লম্বা হয়। বেড় সাধারণত ৭/৮ ফুট হয়। সুন্দরী গাছ নদী বা খাল হতে বনের একটু ভিতরে জন্মে থাকে। সুন্দরী গাছ বেশির ভাগ বনে একক ভাবে জন্মে। আবার গেওয়া, বাইন, কাকড়া, পশুর সহ অন্যান্য গাছের সাথে মিশ্রিত ভাবে জন্মে। কখনও কখনও সুন্দরী বৃক্ষ নদী বা খালের পাড়ে দেখা যায়। সুন্দরবনে যত গাছ আছে তার মধ্যে সুন্দরী গাছই বেশি। সুন্দরবন ছাড়াও সুন্দরী গাছ বাংলাদেশের চকোরিয়া সুন্দরবন, বার্মা ও টেনাসেরিম এ জন্মে থাকে। সুন্দরবনের পুর্ব ও উত্তর মধ্য বনাঞ্চলে সুন্দরী গাছের বিপুল সমারোহ ও বৃদ্ধি বেশি। অপরদিকে দক্ষিণ ও পশ্চিম সুন্দরবনে অর্থাৎ সাতক্ষীরা ও খুলনা রেঞ্জের পশ্চিমাংশে সুন্দরী গাছের পরিমানও বুদ্ধি কম। সুন্দরী গাছের কান্ড বেশ লম্বা হয়। সুন্দরী চির সবুজ বৃক্ষ। বছরের কোন সময়ই এক বারে বৃক্ষের পাতা শূন্য হয় না। পাতা বেশ বড় ও গাঢ় সবুজ। সুন্দরী গাছের প্রধান বৈশিষ্ট হল এ গাছের গোড়ায় রাট্রেস থাকে এবং প্রচুর স্বাস মূল হয়। স্বাস মূলগুলো মাটি হতে ৩০-৪০ সেঃমিঃ উচু হয়। সুন্দরী গাছের ফল জুন-সেপ্টেম্বর মাসে হয়ে থাকে। প্রতি ফলে একটি বীজ থাকে। সুন্দরবনের পুর্ব অংশে ফল আগে পাকে এবং পশ্চিম অংশে ফল পরে পাকে। কাঁচা অবস্থায় ফল সবুজ রং ও পাকা অবস্থায় হলুদ রং এর হয়। ৮০-৯০ টি পাকা ফলে এক কেজি হয়। গড়ে প্রতি গাছে ৩০০০ টি ফল হয়। এক বছর বেশি করে ফল দেওয়ার পর পরবর্তী ২-৩ বছর কম ফল দেয় অথবা কোন ফল হয় না। সুন্দরী গাছ সুন্দরবনের নিচু জলমগ্ন জায়গায় বেশি জন্মায়। শুস্ক মৌসুমে যেখানে জোয়ারের পানি উঠে না সেখানে সুন্দরী গাছ সাধারণতঃ জন্মায় না। সুন্দরবনে সুন্দরী গাছ লাগিয়ে বন সৃষ্টি করা হয় না। প্রাকৃতিক ভাবে গাছ থেকে বীজ মাটিতে পড়ে সুন্দরী গাছ জন্মে বিশাল বনাঞ্চল সৃষ্টি হচ্ছে যুগ যুগ ধরে। জোয়ারের পানিতে সুন্দরী বীচি ভেসে ছোট ছোট খাল দিয়ে বনের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঢুকে সুন্দরী গাছ জন্মায়। সুন্দরী গাছের গোড়া থেকে কপিচ ভাল হয় না। আজকাল সুন্দরবনের অভ্যন্তরে ফাঁকা জায়গায় সুন্দরী চারা দিয়ে বাগান করার চেষ্টা চলছে। পলিব্যাগে চারা করে অথবা বন থেকে চারা সংগ্রহ করে সুন্দরী গাছের বাগান করা যায়। তবে হরিণ বড় শক্র। চারা লাগালেই সময় সুযোগ পেলে হরিণ সব সুন্দরী চারা খেয়ে সাবাড় করে দেয়। সুন্দরী গাছের বৃদ্ধি খুবই কম হয়। প্রতি বছর বনাঞ্চলের উর্বর জায়গায় সুন্দরী গাছের বৃদ্ধি ১.৬ মিঃমিঃ ও খারাপ জায়গায় ৩ মিঃমিঃ হয়। বাংলাদেশের পার্বত্র চট্রগ্রাম, চট্রগ্রাম ও কক্সবাজারের বনাঞ্চলে যেমন বনের সমস্ত গাছ একেবারে কেটে নতুন করে বাগান করা হয়। কিন্তু সুন্দরবনে সব গাছ একেবারে কাটা হয় না। বড় বড় গাছ বেছে কাটা হয়। সুন্দরবনে যে ঘেরে একবার সুন্দরী গাছ কাটা হয় আবার ২০ বছর পর সে জায়গায় সুন্দরী গাছ কাটা হয়। সুন্দরীকাঠ বাংলাদেশের সর্বত্র বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। তবে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরিশাল, পিরোঝপুর, পটুয়াখালী জেলায় গৃহ নির্মাণ কাজে সুন্দরী বেশি ব্যবহৃত হয়। সুন্দরী খুব শক্ত ও মূল্যবান কাঠ। সহজে পানি বা অন্য কিছুতে নষ্ট হয় না। সুন্দরী সার কাঠ লালচে রং এর হয়। সুন্দরী কাঠ নৌকা, ঘর, ট্রাকের বডি, পুল ইত্যাদি তৈরীতে প্রচুর ব্যবহৃত হয়। সুন্দরী বলি দিয়ে বর্তমানে পাইলিং করা হচ্ছে। তা’ ছাড়া সুন্দরী বলি বৈদ্যুতিক খুটি হিসেবে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডে ব্যবহৃত হচ্ছে। সুন্দরী কাঠ দিয়ে কাকড়া বানিয়ে জেলেরা এ্যাংকর হিসেবে ব্যবহার করার ফলে অনেক সুন্দরী গাছ অবৈধ ভাবে অকাতরে নষ্ট হচ্ছে। এর ফলে সুন্দরী গাছের পরিমান সুন্দরবনে দিন দিন লোপ পাচ্ছে।

গেওয়া গাছ

সুন্দরবনে সুন্দরী বৃক্ষের পরেই গেওয়ার স্থান। গেওয়া সুন্দরবনের পত্র ঝরা বৃক্ষ। সুন্দরবন ছাড়াও গেওয়া বৃক্ষ পৃথিবীর অন্যান্য লোনা পানির বনে জন্মিতে দেখা যায়। যেমন ভারত, ম্যালেশিয়া, অষ্ট্রেলিয়া, শ্রীলংকা, সামুয়া প্রভৃতি দেশে। বাংলাদেশের উপকুল অঞ্চলে সুন্দরবন হতে চট্রগ্রাম পর্যন্ত গেওয়া জন্মে থাকে। গেওয়া সুন্দরবনে খালের পাড়ে একক ভাবে এবং অভ্যন্তরে মিশ্রভাবে জন্মে থাকে। গেওয়া গাছের সাথে অন্যান্য যে সব গাছ সহযোগী হিসেবে জন্মে সেগুলো হল সুন্দরী, কাকড়া ও পশুর গাছ। ভ্রমনের সময় নদীর পাড়ে যখন গেওয়া বন চোখে পড়ে তখন গেওয়ার অপুর্ব সমারোহে নয়ন জুড়িয়ে যায়। গেওয়া গাছ উচ্চতায় সুন্দরী গাছ হতে ছোট। সাধারণতঃ ১২-১৫ মিঃ উচু হয়। তবে ১৭ মিঃ উচ্চতায় গেওয়া গাছও সুন্দরবনে পাওয়া যায়। উর্বর স্থানে বুক সমান উচ্চতায় ২০-২৫ সেঃমিঃ বেড়ের গেওয়া গাছ পাওয়া যায়। গেওয়া গাছের স্বাস মূলগুলো সুন্দরী গাছের স্বাস মূল হতে অন্য রকম। সুন্দরী গাছের স্বাসমূল দেখতে পেগের মত চেপ্টা দেখায়। কিন্তু গেওয়া গাছের স্বাস মূল লম্ব্ াগোল আগা পয়েন্টেড (চিকন)। গেওয়া পত্র ঝরা বৃক্ষ। বছরে দু’ বার পাতা ঝরে। একবার এপ্রিল- মে মাসে পাতা ঝরে। আর একবার ঝড়ে সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাসে পাতা ঝরে। জুন জুলাই মাসে গেওয়া ফুল ফুটে। তখন অসংখ্য মৌমাছি গেওয়া ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে। গেওয়া ফুল হতে সংগ্রহকৃত মধুকে গেওয়া মধু বলে। গেওয়া ফল আগষ্ট-সেপ্টেম্বর মাসে পাকে। গাছে ফল থাকতেই অংকুরিত হয়। নদীর স্রোতে বনের এক স্থান হতে অন্য স্থানে বীজ ছড়ায়ে গেওয়া বন সৃষ্টি হয়। গেওয়া গাছ সাধারণতঃ অন্য গাছের নিচে জন্মে। কিন্তু ফাঁকা জায়গায় গেওয়া বেশি জন্মিতে ভাল বাসে। গেওয়া গাছ কপিচ হতে জন্মিতে পারে। ১০-১৫ বছর বয়সের গাছ কাটলে গোড়া হতে ভাল কপিচ হয়। প্রতি বারে ১০ বছর বয়সের কপিচ গাছ গড়ে ১ ঘন ফুট কাঠ দেয়। বীজ হতে যে গেওয়া জন্মে তা থেকে কপিচ গেওয়া গাছের বৃদ্ধি বেশি। সুন্দরবনের পুর্ব অংশে গেওয়ার বৃদ্ধি ভাল। পশ্চিম অংশে অর্থাৎ সাতক্ষীরা রেঞ্জে গেওয়ার বৃদ্ধি স্থবির। গাছ ছোট ছোট। বাছাই পদ্ধতিতে সুন্দরবন হতে গেওয়া গাছ আহরণ করা হয়। বিশ বছর কর্তন চক্রে গাছ আহরণ করা হয়। গেওয়া গাছের কস বা রস অতি বিষাক্ত। গায়ে বা চোখে পড়লে ভীষন কষ্ট হয়। শরীরের যেখানে লাগে সেখানে ঘষতে ঘষতে ব্যথা হয়। অনেক সময় ঘা হয়ে যায়। নিউজপ্রিন্ট তৈরী ও ম্যাচ তৈরীতে গেওয়া গাছ বহুল পরিমানে ব্যবহৃত হয়। গেওয়া কাঠ দেখতে সাদা। আজকাল গেওয়া কাঠের ডিংগি নৌকা তৈরী হচ্ছে। গোলপাতা ও গরাণ আহরনের সময় নৌকার দু’পাশে গেওয়া গাছ ঝোল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া গেওয়া ডাবা ও কচা হিসেবেও বাওয়ালীরা ব্যবহার করে। গেওয়া জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

চলবে।

No comments:

Post a Comment

Follow Us @VisitSundaebon