পর্যটন স্থান নীলকমল (হিরণ পয়েন্ট) : নীলকমল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য কেন্দ্র সুন্দরবনের একটি আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থান। প্রকৃতি পিপাসুদের নিকট বহু আলোচিত দুর্লভ স্থান হিরণ পয়েন্ট নীলকমলের আরেক নাম। বঙ্গোপসাগরের সন্নিকটে নদীর দক্ষিন পাড়ে মনোরম পরিবেশে নীলকমল অভয়ারণ্য কেন্দ্র অবস্থিত।খুলনা হতে নীলমলের দুরত্ব প্রায় ১২০ কিঃ মিঃ। নীলকমলের জনমানব ও নৈসর্গিক প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী দেখে মন উৎফুল হয়ে উঠে। অভয়ারণ্য কেন্দ্রের অফিস গৃহ, বনকর্মীদের বাসগৃহ, পিকনিক স্পট সবই নীল রঙ্গে শোভিত করা হয়েছে। যাতে নীলকমল নামটির সার্থকতা খুজে পাওয়া য়ায়। নীলকমল অর্থ হচ্ছে নীলপদ্ম। দুর থেকে ঘরবাড়িগুলো দেখলে মনে হয় যেন গহীন সুন্দরবনের মধ্যে কয়েকটি নীল পদ্ম ফুটে আছে। নীলকমল খালের নাম অনুসারে এ স্থানটির নাম রাখা হয়েছে নীলকমল। এখানে অনেক হরিণ আছে বলে নীলকমলের আরেক নাম হিরণ পয়েন্ট।
নীলকমলের সাথেই রয়েছে প্রায় ১২ কিঃমিঃ প্রস্থ মর্যাদ নদীর মোহনা যা বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। শীত মৌসুমেই শুধু এ নদী পাড়ি দিয়ে পর্যটকরা অতি আকাংখিত হিরণ পয়েন্ট ভ্রমন করতে যায়। বর্ষা মওসুমে প্রমত্তা এ মর্যাদ নদী পাড়ি দেয়া ভীষন বিপদ। নীলকমল কেন্দ্রে পর্যটকদের থাকার মত কোন রেষ্ট হাউজ নেই। তবে বিশ্রাম ও আনন্দ করার জন্য এখানে মনোরম পরিবেশে দু ’টি বনভোজন কেন্দ্র আছে। এদের একটি হলো “ অবকাশ ” ও অপরটি হলো “ ক্ষনিক ”। নীলকমলে রয়েছে বিভিন্ন রংগে খোচিত পাথরের তৈরী সুন্দরবনের মানচিত্র। কোথায় বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য রয়েছে, কোথায় বাঘ, হরিণ, কুমির, বানর, সাপ, পর্যবেক্ষণ করা যায় এসব গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো এ মানচিত্রে বিভিন্ন প্রাণীর মুর্তি দিয়ে দেখানো আছে। এ মানচিত্রটি দেখলে এক নজরে সুন্দরবন সম্পর্কে একটি সম্যক ধারনা পাওয়া যাবে এবং এর সৌন্দর্যে মন জুড়িয়ে যাবে।
নীলকমলের সকল গৃহই মাচাং টাইপ। ঘরের ভিতর থেকে জানালা দিয়ে কফিপাতা, কেওড়া পাতা, কলা, বিস্কুট ইত্যাদি দিলে হরিণগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে খায়। এতে যে কি মজা আনন্দ লাগে তা প্রত্যক্ষ না করলে বুঝা কঠিন। অভয়ারণ্যের কেন্দ্রের পিছনে দক্ষিনে একটি খোলা মাঠ আছে। এ মাঠে অবাধে অপরাহ্নে ও ভোরে চিত্রা হরিণ বিচরণ করে মনের আনন্দে। মনে হয় এদের কোন ভয় নেই। অভয়ারণ্য কেন্দ্রে একটি বৃহৎ পুকুর আছে। এ পুকুরে একটি পাকা ঘাট আছে। অসংখ্য বন্যপ্রাণী যেমন বাঘ, হরিণ,বানর,বন মোরগ ইত্যাদি প্রাণী পুকুর হতে পানি খায়।
এ বিরল দৃশ্য পুকুর ঘাটে বসে অবলোকন করা যায়। পুকুরের পানি সুপেয়। পুকুরে কেউ গোসল করতে পারে না এবং কাপড় কাচতে পারে না। লোকজন পুকুরের পানি ফুটিয়ে পান করে। সুন্দরবনের বন্য প্রাণী প্রাকৃতিক পরিবেশে দীর্ঘক্ষন অবাধ বিচরণ, চলাফেরা, স্বভাব চরিত্র ও খেলাধুলা প্রত্যক্ষ করার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক বৈচিত্রময় স্থান হলো নীলকমল। নীলকমল খালের দু’ পাড়ে দীর্ঘ চর রয়েছে। এ সব চরে অপরাহ্নে ও সকালে বন্য প্রাণীরা মনের আনন্দে খাদ্যের অনে¦ষনে অবাধে বিচরণ করে। নৌকা দিয়ে ভ্রমন করলে এ দৃশ্য দেখে মন জুড়িয়ে যায়। সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান হলো নীলকমল। অতি নিবিড়ভাবে বন্য প্রাণীকে অবলোকন করার জন্য এখানে ৪৫ ফুট উচ্চ “ বিস্ময় ” নামে একটি পর্যবেক্ষক টাওয়ার রয়েছে। যেখানে টাওয়ারটি অবস্থিত সে জায়গার নাম কেওড়াশুটি। নীলকমল অভয়ারন্য কেন্দ্র থেকে পর্যবেক্ষন টাওয়ার “ বিস্ময় ” যেতে ট্রলারে প্রায় ঘন্টা সময় লাগে। খালের পাড়ে অসংখ্যা বিশাল গোলপাতা গাছ। নাম তার গোলপাতা হলে কি হবে আসলে দেখতে নারিকেল পাতার মত। শীত মৌসুমে নীলকমলের সন্নিকটে বালির গাং, ছিদ্দিক পয়েন্ট, মরাচাঁন্দ বুনিয়া, চাঁন্দবুনিয়া, বন্দেরচর, গলাকাটা, কলাতলী, কালীর চর, সিগন্যাল টাওয়ার প্রর্ভতি এলাকায় মাছ ধরে শুটকি তৈরী করা হয়। এ দৃশ্য খুবই সুন্দর। নীলকমলে দিনের যে কোন সময় অসংখ্য বিভিন্ন বন্যপ্রাণী বিচরণ করতে দেখা যায় যা সুন্দরবনের আর কোথাও এত দেখা যায় না। নীলকমলে চিত্রল হরিণ, বানর, মদনটেক, বিচিত্র ধরনের মাছরাংগা, শুকর, বাঘ, বন মোরগ, গুইসাপ, লালচিল, কালচিল, সাপ, কানিবক, শালিক, টিয়া, বন বিড়াল, কাছিম, গাঙচিল, বাজপাখি, শকুন, আবাবিল প্রভৃতি দেখা যায়।
পর্যটন স্থান শেখেরটেক : এখানে প্রায় ৪০০ বছরের পুরাতন একটি মন্দির, শেখেরবাড়ীর ধবংসাবশেষ এবং কিছু উঁচু জায়গায় ঘরবাড়ীর চিহ্ন পাওয়া যায়। শিবসা নদীর তীরে বনের মধ্যে শেখেরটেক মন্দিরটি অবস্থিত যা ছোট ছোট ইট, চুন ও সুরকীর গাথুনী দিয়ে তৈরী। এর ইতিহাস তেমন জানা যায়নি তবে এখানকার পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে মনে হয় কোন এক সময় এখানে ছোট খাট বসতি ছিল। গভীর জঙ্গলের মধ্যে এ ধরনের সৃষ্ট কীর্তি পর্যটকদের মনে কৌতুহল ও নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করে থাকে।
পর্যটন স্থান হাড়বাড়িয়া : সুন্দরবন দেখে দিনে দিনে ফিরে আসার জন্য হাড়বাড়িয়া একটি উৎকৃষ্ট ট্যুরিষ্ট স্পট হয়ে গড়ে উঠেছে। মংলা থেকে ট্রলার যোগে হাড়বাড়িয়া যেতে সময় লাগে ২ থেকে ৩ ঘন্টা। পশুর নদী ও হাড়বাড়িয়া খালের সংগম স্থলে হাড়বাড়িয়া টহল ফাঁড়ির নিকটে পর্যটকদের আকুৃষ্ট করার জন্য কিছু কিছু স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে।
অন্যান্য বিভিন্ন পর্যটন স্থানের নাম সমুহ : কটকা, জামতলা, কচিখালী, বাদামতলা, তিনকোণা আইল্যান্ড, দুবলার চর, রামসার এলাকা, নীলকমল (হিরন পয়েন্ট), মান্দারবাড়িয়া, শেখেরহাট, হাড়বাড়িয়া, করমজল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য স্পট ছাড়াও সুন্দরবনে আরো বহু ছোট ছোট পর্যটন স্পট রয়েছে যার কিছু উল্লেখ করা হলো- পটনী দ্বীপ, মুন্সীগঞ্জ, কপিলমনি, টিয়ার চর, শেলার চর, ঢাংমারী, জোংড়া, মরা পশুর, ঘাগড়ামারী, লাউডোব, জ্ঞানপাড়া, চাঁদপাই, নন্দবালা, চরাপুটিয়া, মৃগামারী, জিউধারা, বড়ইতলা, আমুরবুনিয়া, শুয়ারমারা, ধানসাগর, গুলিসাখালী, কলমতেজী, নাংলী ইত্যাদি।
.
-চলবে
No comments:
Post a Comment