Wednesday, April 25, 2018

সুন্দরবনঃ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সম্পর্কে কিছু তথ্য - ০৯

বানর : সুন্দরবনের কথা ভাবলে যেমন রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও হরিণের কথা মনে পড়ে তেমনি বানরের কথাও মনে পড়ে। সুন্দরবনে বানর হরিনের বন্ধু। হরিণ যেখানে আছে সেখানে বানরও আছে বুঝতে হবে। সুন্দরবনের প্রায় সর্বত্রই বানর বসবাস করে। প্রায় ৪০ হাজার বানর সুন্দরবনে আছে। এরা সুন্দরবনে ভুষি জঙ্গলে থাকতে বেশী পছন্দ করে। ১০-৩০ টি বা তদউর্দ্ধে বানর হরিণের সাথে দল বেঁধে থাকতে দেখা যায়। সুন্দরবনের বসবাসকারী বানরের প্রধান খাদী হলো কেওড়া, কচি গোলপাতা, ঘাস, কাকড়া, মাছ প্রভৃতি। নদীর ধারের কাদাযুক্ত বন এলাকা এবং কেওড়া বৃক্ষ বানরের অতি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য এলাকা। বানর দুষ্ট প্রকৃতির। বানরের চঞ্চলতা, তার ক্ষিপ্রতা, মেধা সহ সব ধরনের আচরণ পর্যটকদের খুব সহজেই মুগ্ধ করে। সুন্দরবনের বানরগুলো আকারে খুব বেশী বড় হয় না। সুন্দরবনের প্রায় সর্বত্রই এই বানরগুলো দেখা যায়। বিশেষ করে ভাটার সময় নদী বা খালের পাড়ে খাবারের সন্ধানে এলে এদের বেশী দেখা যায়। এছাড়াও গাছের ডালে ডালে এদের বিচরণ লক্ষ করা যায়। পুরুষ বা মর্দা বানর একটি মহিলা বানরের চেয়ে দু’ তিন কেজি বেশী ওজনের হয়। একটি বানর গড়ে ৭-৮ কেজি হয়। বানরের লেজের কাছ থেকে পুরু পেছনটা সিদুরের মত লাল। প্রতি দলে একজন দলপতি আছে। বানরের দলের দলপতি তার দল খুব সুশৃংখল রাখে। এতে কখনো কখনো শাসন করতে হয়। প্রয়োজনে মারধরও করে। সারা বছর বানরের প্রজনন সময়। বানরের জীবনে পানি খুবই প্রয়োজন। প্রতিদিন বানর ১-২ কেজি পানি খায়। সকালে অথবা বিকেলে নদী থেকে এদের পানি খেতে দেখা যায়। বাচ্চা দেয়ার পর বাচ্চা মায়ের সাথে খাকে। তিন মাসের মত বয়স হলে এরা মায়ের কাছাকাছি থেকে খাদ্য গ্রহণ ও খেলাধুলা করে। দুপুরে এরা ঘুমাতে ভালবাসে। সব সময় এরা হরিণের সাথে সাথে থাকে। গাছের পাতা ছিড়ে মাটিতে ফেলে আর হরিণ খায়। বিপদ আপদে সংকেত দিলে হরিণ ভয়ে পলায়ন করে।

কচ্ছপ :সুন্দরবনে পাঁচ প্রজাতির কচ্ছপ আছে। যথা- অলিভ রিডলি, সবুজ, লোকারহেড, হক্সবিল এবং লেদারব্যাগ। এর মধ্যে বেশী পাওয়া সবুজ কচ্ছপ। কচ্ছপ সুন্দরবনের সর্ব দক্ষিনে সমুদ্র উপকুলে পাওয়া যায়। সাধারণতঃ মান্দারবাড়িয়া, পুতনি চর, পক্ষীর চর এলাকায় শীতকালে এদের বিচরণ করতে দেখা যায়। চর এলাকায় ডিম পাড়তে আসা এ সমস্ত কচ্ছপের দেখা পেলে পর্যটকরা ভীষন আনন্দ পায়।

গাপ : সুন্দরবনের গভীর অরণ্যে বিভিন্ন ধরনের সাপ বাস করে। অনেক সাপ আছে বিষধর। আবার অনেক সাপ আছে বিষধর নয়। এদের সচরাচর পানি ও ডাংগায় বিচরণ করতে দেখা যায়। সুন্দরবনের উল্লেখযোগ্য সাপের মধ্যে অজগর, জলবোরা, কোবরা, গোখরা, সুন্দরী সাপ প্রধান। সুন্দরবনে সর্বত্র সাপ বাস করে। তবে বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যে বেশী সাপ দেখা যায়। চিল সুন্দরবনের সাপ ধরে খায়। অজগর সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় সাপ। একটা অজগর সাপ সাধারণতঃ ১০-২০ ফুট লম্বা হয় এবং ওজন ২-৩ মন হয়ে থাকে। অজগর বেশ মোটাসোটা হয়। অজগর মসৃন আঁশে মোড়া বেশ চকচকে। সমস্ত শরীর কালো-সাদা। পিঠের মূল রং হাল্কা হলুদ, ক্রিম ধুসর বা বাদামী হয়। অজগর বেশ অলস। এরা খুব ধীর গতিতে চলে। অজগর নদীর কিনারা এবং বৃহৎ জলাশয় বেশী পছন্দ করে। অজগর এত অলস যে খাবারের সন্ধানে ঘুরাফেরা করার ধৈর্য্য পর্যন্ত এদের নেই। অজগর গাছে চড়তে পারদর্শী। গাছে চড়ে এরা লেজ গাছের ডালে পেচিয়ে দুলতে থাকে। খাবার সামনে দিয়ে গেলে প্রথমে এরা কামড় দিয়ে ধরে ফেলে। তারপর প্রাণীটিকে এক দু’ প্যাচ দেয়। এতে শিকার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়। আবার খাবারের সন্ধানে অজগর বনের মধ্য দিয়ে চলাচল রাস্তার ধারে, কোন ডোবা-নালার পাড়ে বা গর্তের ধারে ওৎ পেতে থাকে। শিকার গেলে ধরে খায়। অজগরের প্রধান প্রধান খাদ্য হলো ইদুর, হরিণ শাবক, শুকর, বানর, পাখি প্রভৃতি। অজগর শীতের পর ডিম দেয়। একটি স্ত্রী অজগর সর্বাধিক ১১০টি ডিম দেয়। ছোট গর্ত করে, গাছের গহ্বরে বা নির্জন গুগায় অজগর ডিম পাড়ে। ডিম ফুটতে সময় লাগে ৬০-৮০ দিন। ডিমে তা দেয়ার পুরো সময় মা অজগর উপবাস থাকে। ডিম ফুটে বাচ্চা বেরুলে প্রায় ২-৫ ফুট লম্বা হয়। সাপের কোন হাত পা নেই। তারা সারপেনটাইন মুভমেন্ট বা লোকমুশান বা সাপাগতি পদ্ধতিতে চলাফেরা করে। এরা এস এর মত চলে। সাপের মাথার দিকে একটি এস এর মত ভাজ আছে। সে ভাজ লেজ পর্যন্ত চলে যায়। প্রতিটি ভাজের সাথে মাটির অমসৃণতা বাধা পায়। ফলে সাপের পেশি সংকোচন জনিত কারণে যে শক্তি সৃষ্টি হয় তা ব্যবহার করে সাপ চলাফেরা করে। সাপের চামড়া খুবই দামী।

গুইসাপ : গুইসাপ এক ধরনের সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী। সুন্দরবনে প্রচুর পরিমানে গুইসাপ বাস করে। গুইকে সাপ বললেও আসলে এরা সাপ নয়। কারণ সাপের হাত পা নেই। কিন্তু গুইসাপের হাত পা আছে। সাপ লোকমুশান আ সাপাগতি পদ্ধতিতে চলাফেরা করে। আর গুই সাপ হাত পা দিয়ে চলাফেরা করে। সুন্দরবনে তিন ধরনের গুইসাপ আছে। যথা- ব্যয়গন মনিটর, হলুদ মনিটর ও র্যাকডি সাব রোজড মনিটর। নন্দবালা খাল জোংড়া খাল, কচিখালী, নীলকমল ও মান্দারবাড়িয়া বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে বেশী গুই সাপ দেখা যায়। পানিতে যখন গুইসাপ সাতার কাটে তখন বেশ সুন্দর দেখায়। বাইন বা বড় পুরাতন গাছের কুঠরীতে গুইসাপ বেশী বাস করে এবং তথায় ডিম পাড়ে।

শুকর : শুকর সুন্দরবনের একটি উল্লেখযোগ্য বন্যপ্রাণী। এরা সুন্দরবনের সর্বত্র বাস করে। সুন্দরবনের বাঘের প্রধান খাদ্য হল হরিণ। কিন্তু হরিণ না পেলে বাঘ বেশী পছন্দ করে শুকরকে। অনেক সময় হরিণ ও শুকর একত্রে বিচরণ করে থাকে। কচিখালী অভয়ারন্যে হরিণ ও শুকরকে একত্রে বিচরণ করতে দেখা যায়। বয়স্ক শুকরের গায়ের রং কাল। বাচ্চা অবস্থায় গায়ের রং ধুসরের উপর গাঢ় ডোরা কাটা থাকে। কয়েক মাসের মধ্যে গায়ের ডোরা বিলুপ্ত হয়ে যায়। যৌবনে গায়ের রং গাঢ়-ধুসর বর্নের হয়। শুকরকে সর্বভোগী প্রাণী বলা হয়। সুন্দরবনের শুকর গাছের মূল, কান্ড, বীজ, কাকড়া, শামুক, ঝিনুক, চিংড়ি মাছ, সামুদ্রিক কচ্ছপের ডিম, মৃত মাছ সহ অন্যান্য প্রাণী খেয়ে জীবন ধারণ করে। বাঘের খাওয়ার পর বাকী যে অংশ থাকে তাও শুকর খায়। শুকর খুব হিংস্র প্রাণী অনেক সময় দাতাল শুকরের সাথে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের যুদ্ধ বেধে যায়। আবার অনেক সময় শুকরে শুকরে মারামারি হয়। সুন্দরবণ ভ্রমনের সময় এ বিরল দৃশ্য উপভোগের সৌভাগ্য ভ্রমনকারীদের হয়ে থাকে। কচিখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারন্যে বেশী শুকর দেখা যায়। শুকরের যত্রতত্র বিচরনের ফলে নৃতন গাছ জম্মানোর বাধাগ্রস্থ হয়। এরা অঙ্কুরিত চারা, বীজ খেয়ে প্রাকৃতিক ভাবে বন গঠনে প্রতিকুল অবস্থার সৃষ্টি করে। গহীন বনে যখন একাকী শুকর দাড়িয়ে থাকে তখন দেখতে সুন্দর লাগে। ঘন সবুজের মাঝে কাল একটি বন্যপ্রানীর উপস্থিতি সুন্দর মানায়। কোন কোন সময় বিশ বা ততোধিক শুকর দলবদ্ধভাবে বিচরণ করতে দেখা যায়। সুন্দরবনের শুকর ডিসেম্বর-জানুয়ারী মাসে মিলিত হয়।এ সময় এদের প্রজনন সময়। শুকরের গর্ভকাল হল ৩-৫ মাছ। সাধারণতঃ সুন্দরবনের শুকর এপ্রিল-মে মাসে বাচ্চা প্রসব করে। একটি মহিলা শুকর এক সংগে ছয় বা ততোধিক বাচ্চা প্রসব করে। বাঘ কর্তৃক শুকর ছানা ভক্ষনের কারনে আশাতিতভাবে শুকরের সংখ্যা সুন্দরবনে বাড়ছে না। বাংলাদেশের অন্যান্য বনের শুকর উপজাতীয়রা শিকার করে মাংস খায়। কিন্তু সুন্দরবন সংলগ্ন উপজাতীর আবাস না থাকায় অবৈধ শুকর শিকার সুন্দরবনে নেই বললেই চলে। সুন্দরবন হতে মাংসের জন্য অতি সামান্যই শুকর শিকার হয়।

-চলবে

No comments:

Post a Comment

Follow Us @VisitSundaebon