Sunday, April 29, 2018

সুন্দরবনে জলযাত্রা

সুন্দরবন ভ্রমণের সময় এটা নয়। কিন্তু আমাদের উদ্যোক্তা মোস্তফা ভাই খুব বিপ্লবী কিসিমের মানুষ। অন্তত সুন্দরবনের ক্ষেত্রে। তিনি বললেন, সুন্দরবনে যাওয়ার আবার সময়-অসময় কি?

একাই দৌড়ঝাঁপ করে দিন পনেরোর মধ্যে তিনি সুন্দরবন যাওয়ার সব আয়োজন শেষ করে ফেললেন।

বিশ জনের দলটা রওনা হয়ে গেলো সুন্দরবনের দিকে। মাঝারি মাপের একটা জাহাজে। আমাদের অধিকাংশের ধারণা ছিল সদরঘাট অথবা বুড়িগঙ্গার কোনো এক জায়গা থেকে আমরা উঠবো। কিন্তু শেষ দিকে জানা গেলো আমাদের সবাইকে উঠতে হবে ডেমরা ঘাট থেকে। আমাদের ট্যুরের পুরো দায়িত্ব ’দি গাইড ট্যুরস লিঃ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ঘাড়ে।

নির্দিষ্ট দিন দুপুরে আমরা একত্রিত হলাম হোটেল শেরাটনের গাইড ট্যুর অফিসে। সেখানে তাদের গাড়ি করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো ডেমরা ঘাটে। গাইড ট্যুরের জাহাজটা ঠিক ডেমরা ঘাটে থাকে না। থাকে একটু দূরে। অবশেষে স্পিডবোটে করে আমাদের তোলা হলো জাহাজে।

 

তখন প্রায় শেষ বিকাল। আমাদের জাহাজ রওনা দিলো সুন্দরবনের উদ্দেশে। ভ্রমণে পুরুষদের তুলনায় নারীদের উৎসাহ বোধহয় বেশি থাকে। দলের নারী সদস্যরা সবাই জাহাজের রেলিং ধরে উপভোগ করতে লাগলো বাতাস ও নৌযাত্রা। পুরুষরা এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করে জাহাজের অন্যতম আকর্ষণ তাস খেলার দিকে মোড় নিলো। কেবিনে কেবিনে চলছে কার্ডস খেলা। সময়ের সাথে সাথে এক সময় প্রিয়ার কালো চোখও ঘোলাটে হয়ে যায়। নারী সদস্যরাই বা আর কতোক্ষণ উপভোগ করবে বাতাস কিংবা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। তাছাড়া রাতের বেলা প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে চাওয়াটা বুদ্ধিমানের পরিচয়ও নয়। তাই রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারাও ভিড় বাড়াতে থাকে তাসের আসরের আশপাশে, দুএকজন কার্ডস খেলা জানেও। কেউ আহলাদ করে বলে ‘শিখিয়ে দেন, তাহলেই পারবো’।

কেবল খেলতে জানলেই তো চলবে না, দক্ষ খেলুড়ে হতে হবে। বাধ্য হয়ে মেয়েদের হাতে এক সেট কার্ড তুলে দিয়ে বলা হলো- যাওগা, তোমরা তোমাদের মতো করে খেলো।

আমরা সবাই কেবিনে খেলায় ব্যস্ত। জাহাজ যে থেমে আছে বুঝতেই পারিনি। পরে জানা গেলো, সারারাত তারা জাহাজ চালায় না। রাত গভীর হওয়ার আগেই তারা জাহাজ নোঙর করে ঘুমিয়ে পড়ে। কাকভোরে আবারো রওনা দেয়। রাত পর্যন্ত একটানা চলতে থাকে। নৌপথে কিছু কিছু পয়েন্ট আছে যেখানে রাতে জাহাজ নোঙর করা হয়। পুলিশ ফাঁড়ি এবং লোকালয়ের আশেপাশে। প্রতিরাতে একাধিক জাহাজ এই পয়েন্টগুলোতে নোঙর করে দম নেয়। আমাদের জাহাজ প্রথম নোঙর করে চাঁদপুরের কাছাকাছি কোনো এলাকায়। ভোরে আবার চলতে শুরু করে।

সারাদিন জাহাজ চলে বিকালের দিকে পৌঁছে গেলো খুলনার কাছাকাছি। সিগারেট এবং চায়ের জন্য চিনি কিনতে হবে। জাহাজ নোঙর করলো দূরে গ্রাম্য হাটের মতো একটা বাজার দেখা যাচ্ছে সেখানে। কার কি লাগবে সেই তালিকা নিয়ে। স্পিডবোটে করে আমাদের কয়েকজন রওনা হলো বাজারে। ভ্রমণ দলের একমাত্র সাদা চামড়া বিদেশী হ্যারি বললো সে খুব ভালো সাঁতার জানে। আমরা মুখ টিপে হাসি- ব্যাটা তোমার দেশে তো নদীই নাই, ভালো সাঁতার জানবে কিভাবে? আমাদের নারী সদস্যরা হ্যারিকে উসকে দিলো- হ্যারি তুমি নিশ্চয়ই ভালো ডাইভও দিতে জানো। হ্যারি বলে- নিশ্চয়ই! তাহলে তুমি এই দোতলা থেকে দাও না একটা ডাইভ। আমরা দেখি। হ্যারি সামান্য দোনোমনো করলে মেয়েরা বোঝালো, ওই যে দেখো আমাদের স্পিডবোট এখনো বাজারে পৌঁছায়নি। বাজারে যাবে, সবার জন্য কেনাকাটা করবে। তারপর ফিরবে। ততোক্ষণে তুমি সাঁতার দিয়ে কাপড় পাল্টে আবারও মি. হ্যারি হয়ে যেতে পারবে। হ্যারির চেহারায় দোটানা ভাব। এতো স্রোত সামলাতে পারবে তো! কিন্তু মেয়েদের প্রস্তাবে রাজি না হলে পৌরুষ হারানোর ভয়। আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে হ্যারি তার টি-শার্টটি খুলে ফেলে। পরনে শুধুই শর্টস। দোতলার রেলিং পেরিয়ে জাহাজের প্রান্তে দাঁড়ালো হ্যারি। ডাইভ দিলো। সেটা কোনো ডাইভ নয়। মাথা নিচু করে পানিতে পড়া। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাথাটা তার নিচু থাকলো না। বুক, পেট, মাথা, পা সহ এক সঙ্গে থপ্‌ পানিতে পড়লো হ্যারি। ডুবে গেলো পানিতে। পনেরো-বিশ সেকেন্ড পার হয়ে যায়, হ্যারিকে দেখা যায় না। খুবই টেনশনে পড়ে গেলাম। ডাইভ দিতে গিয়ে নিশ্চয়ই পানিতে আঘাত পেয়েছে। জাহাজের ক্রুদের বলবো কিনা- এমন সময় হ্যারি ভেসে উঠলো হাসিমুখে। মেয়েদের কালোমুখগুলো উজ্জ্বল হতে থাকলো। আমি কেবিনে গেলাম। একটু বিশ্রাম নেয়া দরকার। শুধু খেলা আর আড্ডাবাজির ওপর আছি। মিনিট পাঁচেক পরেই দরজায় নক। তোজো ভাই, দ্রুত আসেন হ্যারিকে পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া যাচ্ছে না মানে? ওকে সাঁতরিয়ে জাহাজের দিকে আসতে দেখলাম। স্রোতের কারণে আসতে পারেনি। ওই যে দেখেন, স্রোত ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। চেষ্টা করেও হ্যারিকে দেখতে পেলাম না। সবার হৈ-চৈ শুনে ক্রুরা এসে তিন কয়েল রশির সঙ্গে টিউব বেঁধে ছেড়ে দিলো। টিউব এগিয়ে যাচ্ছে হ্যারির দিকে, হ্যারি পিছিয়ে যাচ্ছে স্রোতের টানে। আমরা কিছু দেখছি না কিন্তু যারা আগে থেকে হ্যারিকে দেখেছে তারা বলছে- ও-ই যে হ্যারি। স্রোতের মধ্যের বিন্দুটা।

স্পিডবোটটাও নেই। গেছে বাজারে। থাকলে নিমেষে হ্যারিকে উদ্ধার করা যেতো। আমাদের যখন দমব অবস্থা, ঠিক তখন একটা যাত্রবাহী ট্রলার আসছিল হ্যারির দিকে। হ্যারিকে দেখে ট্রলার তার কাছে গেলো, তাকে টেনে তুললো, আমরা দেখছি। জাহাজে নিয়ে এলো হ্যারিকে। ট্রলারের যাত্রীরা একেকজন একক কথা বলছিলো। ওরা যতোক্ষণ রইলো আমরা সবাই সমানে তাদের ধন্যবাদ জানাতে লাগলাম। এমন সময় দলনেতা মোস্তফা ভাই স্পিডবোট নিয়ে এলেন কি হয়েছে? এখানে এতো ভিড় কিসের?

আমাদের জাহাজ রওনা দিল। রাত দশটার দিকে আমরা পৌঁছলাম সুন্দরবনের প্রান্তে। শরণখোলা ফরেস্ট রেঞ্জ এলাকায়। জাহাজ নোঙর করা হলো। আমাদের সেখানে অনুমতি নিতে হলো সুন্দরবনে যাওয়ার। শোনা গেলো ইদানীং সেখানে ডাকাতের উৎপাত ঘটে। আর ডাকাত না থাকলেও আছে বাঘের ভয়। ফলে দু’জন গানম্যান ভাড়া করা হলো। একজনের শরীর এতোই পেশি বহুল যে তাকেই ডাকাত মনে হয়। তার হাতে বন্দুকটা খুবই বেমানান লাগছিল। খেলনা খেলনা মনে হচ্ছিল। বন্দুকের ভয়ে নয়, পেশির ভয়েই বাঘের আসার কথা নয় তার আশেপাশে। পরদিন খুব সকালে জাহাজ ছাড়লো। আমাদের লক্ষ্য কটকা অভয়ারণ্য। ঘন্টা চারেকের মধ্যে পৌঁছে যাওয়ার কথা কটকায়।

দুদিক ঘন বন। সেই বন চিরে বয়ে গেছে নদী। সেই নদী চিরে ছুটে যাচ্ছে আমাদের জাহাজ। আমাদের দলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো। কেউ বলছে এতোক্ষণ ধরে বনের মধ্য দিয়ে ছুটছি একটা ইঁদুরও দেখলাম না। কারো মন খারাপ, সে ভেবেছিল এখানকার পানি হবে খুবই স্বচ্ছ। কিন্তু পানি ভয়াবহ ঘোলা। কেউ ভেবেছিল বন মানে টারজানের বন; যেখানে কলা-কাঁঠাল জাতীয় বন্য ফলমূল থাকবে, থাকবে ফুল। তার আশাভঙ্গ হয়েছে। এ তো শুধুই জঙ্গল! কেউ কেউ সুন্দরবনের ‘সুন্দরী’ গাছ দেখার জন্য উদগ্রীব। অথচ কেউই বলতে পারছে না কোনটা সুন্দরী গাছ। একেকজন এককটাকে বলছে। কেবল নদীর ধারে গোলপাতাটাকে শনাক্ত করা গেলো। কি আর করা, সব উৎসাহ গোলপাতাকে ঘিরেই শুরু হয়ে গেলো। এ ওকে বলতে লাগলো, এই যে নদীর ধারে দেখছিস না লম্বা লম্বা পাতা ওগুলোর নাম গোলপাতা। হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি জানি। কিন্তু তুই বলতো, কেওড়া গাছ কোনটা? কেওড়া গাছ না চিনতে পারার কারণে সে হয়তো উল্টো বলে বসছে- আরে গাধা সুন্দরবনে এসে কেউ বেওড়া গাছ খোঁজে নাকি? সুন্দরবন বিখ্যাত সুন্দরী গাছের জন্য। বলতো, সুন্দরী গাছ কোনটা?

এর মধ্যে আমাদের ডাক পড়লো সবার। উদ্দেশ্য- সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শোনানো। আমাদের গাইড শোনাচ্ছেন। সুন্দরবন এলেই সুন্দরবন দেখা যায় না। এখানে নিজের মনটাকে বনের সঙ্গে একাত্ম করতে হয়। তা না হলে বনের ভাষা বোঝা যায়! আপনারা কেউ সিগারেটের টুকরা, চকলেট-চুইংগামের খোসা নদীতে ফেলবেন না। পরিবেশ দূষিত হয়। কেউ উচ্চস্বরে কথা বলবেন না। প্রাণীদের ডিসটার্ব করা হয়। ইত্যাদি, ইত্যাদি।

এরই মধ্যে আমাদের জাহাজ কটকা অভয়ারণ্য এলাকায় নোঙর করলো। অধিকাংশের মধ্যে দেখা গেলো একই সঙ্গে বিপরীত প্রতিক্রিয়া। বনে ঢোকার আগে কারো কোনো ভয়-ডর দেখা যায়নি। কিন্তু বনে ঢোকার পর অধিকাংশের মধ্যে চাপা বাঘের ভয় দেখা গেলো। কিন্তু পাশাপাশি সবাই বাঘ দেখতেও চায়।

খুব চুপচাপ এবং এক ধরনের ভাবগম্ভীর পরিবেশের ভেতর দিয়ে আমরা রওনা হলাম কটকা পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের দিকে। গাইড বাচ্চু ভাইয়ের মতে, ভাগ্য ভালো থাকলে এই টাওয়ার থেকে বাঘ দেখা সম্ভব।

দলের অনেকে বিশেষত মেয়েরা বাঘের ভয়ে ভীত। কিন্তু খামাখা বাঘের ভয় পেয়ে অসুস্থ হওয়ার তেমন মানে নাই। কারণ, বাঘ মাত্রই মানুষ খায়, আমাদের মধ্যে প্রচলিত এই ধারণা ভিত্তিহীন।

বিশেষ কিছু পরিস্থিতিতে বাঘ মানুষ খেকো হয়। এই ধরনের বাঘকে বলে ‘ম্যান-ইটার’ বা ‘ম্যানিটার’। খুব বাস্তব ধরনের তিনটা কারণে সাধারণ বাঘ ‘ম্যানিটার’ হয়।

এক. যে বাঘটা বনের যে অঞ্চলে থাকে সেই অঞ্চলে যদি তার খাদ্য স্বল্পতা থাকে।

দুই. যদি বাঘটার বয়স বেশি হয় এবং বার্ধক্যজনিত কারণে ক্ষিপ্র প্রাণী হরিণ-বানর এসব ধরার শারীরিক ক্ষমতা না থাকে।

তিন. যদি বাঘটা আহত হয়ে থাকে।

আমাদের গাইড আমাদের আশ্বস্ত করলেন, এই অঞ্চলে ম্যানিটার বাঘ নাই।

উঁচু পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে উঠে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। পাশেই বঙ্গোপসাগর। টানা গর্জন সমুদ্রের। আমাদের অভ্যস্ত জীবনের সম্পূর্ণ উল্টো পরিবেশ। এই পৃথিবী, এই বিশাল প্রকৃতি; সৃষ্টি সম্পর্কে অন্যভাবে ভাবতে শেখায়।

অনেকক্ষণ টাওয়ারে বসেও বাঘের দেখা মেলে না। আমরা বনের ভিতর ঢুকে যাই। অদ্ভূত নিস্তব্ধতা। বন পেরিয়ে পৌঁছে যাই সাগরপাড়ে। বঙ্গোপসাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ছে সুন্দরবনের পায়ে। সুন্দরবনকে হাত দিয়ে ছুঁয়ে আমরা ফিরে আসি জাহাজে। তখন ভাটা শুরু হয়েছে। দ্রুত পানি কমে যাচ্ছে। সেখানে নেমে আসছে হরিণের দল। পানি খাচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে। একেবারেই নিরাপদ তারা। মানুষ নিজেদের জন্য না পারুক, পশু-পাখিদের জন্য যে অভয়ারণ্য তৈরি করতে পেরেছে এও কি কম! কি সুন্দর আমরা গাছপালা-পশু পাখি দেখতে গিয়েছি এতোদূর, ওরা কি কখনো আমাদের দেখতে আসবে?

সুন্দরবনে প্যাকেজ ট্যুর

অনেকেই বলেন মনোহরণ সুন্দরবন, এর দেখার শেষ নেই। এই মনোহরণ বন দেখার রহস্যময় হাতছানিতে পৃথিবীর দূর-দূরান্ত থেকে ট্যুরিস্টরা আসেন। অথচ এদেশের মানুষেরই সুন্দরবন দেখা হয়ে ওঠে না। চাইলেই কিন্তু আপনি বা আপনারা সুন্দরবন দেখে আসতে পারেন, তার জন্য দরকার একটু সময় খুঁজে বেরিয়ে পড়া। এদেশে এখন সুন্দরবন বেড়ানোর ব্যবস্থা নিয়ে ভ্রমণ বিলাসীদের জন্য বেশ কয়েকটি সংস্থা নানাধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অপেক্ষা করছে। আপনার থাকা, খাওয়া থেকে শুরু করে নানাধরনের প্রয়োজন মেটাতে তারা সদাতৎপর।



লিখেছেনঃ আলি ফিদা

No comments:

Post a Comment

Follow Us @VisitSundaebon