Sunday, April 29, 2018

সুন্দরবনের গভীর অরণ্যে এক দিন

আগে শুনতাম মানুষের মুখে। বন্ধু প্রিয়জন কিংবা আত্মীয়স্বজনের কাছে। ভাবতাম স্মৃতির আঙ্গিনার এ পাশে থেকে ও পাশ ছুটে বেড়াতাম। দু’চোখ ভরা স্বপ্নে বিভোর হতাম। কত না সুন্দর! সুন্দর সেই সবুজ বনটি, কত না মনোরমে সাজানো কে জানি, কী আছে তাতে? কেন মানুষ তার প্রশংসায় উল্লসিত? কেন দৌড়ঝাঁপ চলছে তাকে সপ্তাযেêর একটি বানাতে? হাজারো প্রশ্ন এসে জমা হতো হূদয়-কোণে।

অদূর আকাশের শূন্যতায় একটি ছবি আঁকতাম। কখন সময় হবে? কখন ছুটে যাবো ওই সবুজ বনের ধারে? অধীর আকাঙ্ক্ষার প্রহর কেন বারবার নাড়া দিচ্ছিল। আর কত দেরি? অবশেষে অপেক্ষা শেষ হলো। প্রিয়জন ছুটে যাচ্ছে ওই গভীর অরণ্যে? গভীর সে বন, মাঝে মধ্যে আঁকাবাঁকা পথ। বাঘের গজêন, বানরের লাফালাফি, হরিণের দৌড়ঝাঁপ, সারি সারি বৃক্ষরাজি, নানা ধরনের ঝোপ­ এ যেন অন্য রকম এক আনন্দ! সত্যি, বণêনাহীন সুন্দরের মালা পরে সেজে আছে গভীর অরণ্যের সুন্দরবন।

২৮ ফেব্রুয়ারি উল্লসিত প্রিয়জনরা ট্রেন ছাড়ার আধঘণ্টা আগেই ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে পৌঁছে যায়। সবার চোখেমুখে এক অন্য রকম আনন্দের আভা ফুটে আছে। হাসিমাখা রহস্যবাক্যে আমাদের ছুটে চলাকে আরো আনন্দময়ী করে তোলে।

স্টেশনে নয়া দিগন্ত দাউদকান্দি প্রতিনিধি হানিফ ভাইয়ের সাথে দেখা। তিনি হেলান দিয়ে বসে আছেন আর পান চিবুচ্ছেন। তার আশপাশে আরো কয়েকজন। কেউ ব্যাগ নিয়ে টানাটানি করছে। কেউ খুঁজছে বি.সকে। কারণ কত নম্বর বগিতে টিকিট তা তিনি ছাড়া কেউ জানে না। তা ছাড়া অনেক প্রিয়জন এর আগে কখনো ট্রেনেই ভ্রমণ করেনি­ তাদের আগ্রহ আরো বেশি।

স্টেশনের এক পাশে বি.সকে দেখা গেল। তিনি বেশ উদাস। সকালে তার নানী মারা গেছেন। তাকে দাফন করে সোজা স্টেশনে এসেছেন তিনি।

থপাস করে কিসের আওয়াজ হলো? বুঝলাম বিগম্যান প্রিয়জন জাহাঙ্গীর প্লাটফমেê হাঁটাহাঁটি করছেন। তার পেছনে সুমন-নাঈমসহ আরো অনেক প্রিয়জন দাঁড়িয়ে। প্রিয়জন সুমন বললেন, আনন্দ উৎসবের ব্যান্ডপাটিê নেই এটা কেমন কথা। অন্তত একটা ঢোল থাকলেও চলত। কথাটা শুনে সবাই হেসে ওঠে। এবার হাসির রোল পড়ল দ্বিগুণ। এরই মাঝে এসে পৌঁছে গেল প্রিয়জন ইলিয়াস। তিনি সবার জন্য সিঙ্গাড়া আর ডিম এনেছেন। কিন্তু এত সব আয়োজনের কী দরকার তা পরিষ্কারভাবে বোঝা গেল না।

ট্রেন ছাড়ার আগে ছোটখাটো একটা আড্ডা বসল প্লাটফমেê। সেখানেই বি.স ইলিয়াসের হাতে তুলে দিলেন প্রিয়জনের পক্ষ থেকে ফতুয়া উপহার। ইলিয়াস এতেও খুশি হতে পারল না। কারণ এই আনন্দ আয়োজনে তিনি আমাদের সাথে যেতে পারছেন না। মৃতুøর কোল থেকে ফিরে আসা এই মানুষটি প্রিয়জনদের এক নজর দেখতে তাদের সামান্য একটু আপ্যায়নে নিজেকে অল্প তৃপ্তে ধন্য করতে বহু কষ্ট করে স্টেশনে ছুটে এলেন। ইলিয়াস ভাইয়ের এমন আন্তরিকতা আমাদের যাত্রাকে আরো আনন্দময়ী করে তুলেছে। তবে সন্ধ্যার পর থেকেই স্টেশনে কারন্টে ছিল না। কেমন জানি একটা ভুতুড়ে অবস্থা হয়ে আছে। অন্ধকার। তবে অদ্ভুত আকাশের উদিত চাঁদমামার হাসিতে আমরা একটু স্বস্তি পাচ্ছিলাম।

ট্রেন এলে সবাই দ্রুত দৌড়ে ছুটেছে আলোকিত ট্রেনে নিজ আসনটি বেছে নিতে। আমরা প্রিয়জনরা সবাই এক সাথে দাঁড়িয়ে। জানা গেল আমাদের সিট ‘ঙ’ নম্বর বগিতে। ‘ঙ’ নম্বর বগি খুঁজতে সবাই ব্যস্ত। কিন্তু একি! ‘ঙ’ গেল কোথায়। আদশêলিপি তিনবার পড়ি, তিনবাপরই ‘ঘ’-এর পর ‘ঙ’ আসে। কোনোবারই ‘চ’ খুঁজে পাইনি। কিন্তু এখানে দেখি উল্টো সিস্টেম। ‘ঘ’-এর পরে ‘চ’ তারপর ‘ঙ’।

ট্রেনে ওঠার পরই বুঝলাম আজ রাত কেউ ঘুমাবে না। তারপর চাঁদমামা যেভাবে হাসছে তাতে কারে ঘুম আসার কথা না। তার পরও শামিম আহমেদ, আরিফুল ইসলাম, নুসরাত জাহান, সাদিয়া, কফিল উদ্দীন, আবদুল মান্নান, নাজমা আত্ত্নার, মেহেদী হাসান, শরিফুল ইসলাম, জসিমউদ্দীন, মামুন মিয়া, কামরুল হাসান, কবি ফজলুল হক, আবদুল বাতেন, কারিমা আত্ত্নার, রফিকুল ইসলাম, লালবাগের শফিকুল ইসলাম আয়েশ করে বসে পড়ল সিটে। বোঝাই যাচ্ছে ট্রেন ছাড়ার সাথে সাথে তারা নিদ্রাপুরিতে যেতে চায়। কিন্তু তার আগেই সিট নিয়ে নানান ঝামেলা শুরু হলো। ট্রেনে সিটবিহীন যাত্রীর সংখ্যা অনেক। তাদেরই একজন এসে বসেছে প্রিয়জনের সিটে। তাকে কিছুতেই তুলে দেয়া যাচ্ছে না। তবে সিট নিয়ে যত সমস্যাই হোক ট্রেন ছাড়ল সময়মতো। বেশ অবাকই হলাম। ভাবতেই ভালো লাগে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।

দাউদকান্দি প্রিয়জনের মোঃ হানিফ খান, মোস্তাফিজুর রহমান, কাজী হেলাল, মোঃ রুহুল আমিন, শরীফুজ্জামান জসিম, মোঃ হাছান খান, মাহবুবা ইসলাম বেছে বেছে ভালো সিট নিয়েছেন­ এমন অভিযোগ পেলাম। ট্রেনের মাঝ বরাবর ব্যানার ঝুলিয়ে দেয়া হলো। সেই বগিতে উঠে তিনিই কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। এমন কি টিকিট চেকার এসেও কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। এত চিল্লাপাল্লা করছে সবাই তার পরও সবাই যেন মজাই পাচ্ছে। কেউ বিরত্ত্ন না।

রাতে সবাই এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল। এমন সময় কোত্থেকে এক মহিলা এসে হাউকাউ শুরু করে দিলো। বিরত্ত্ন প্রিয়জনদের অনেকেই ছুটে গেল। কিন্তু কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই মহিলার। আসলে কমনসেন্স না থাকলে যা হয়। গভীর রাতে ট্রেন যখন বঙ্গবন্ধু সেতু আর হাডিêঞ্জ ব্রিজ পার হচ্ছিল তখন সবাই ভিড় করল জানালায়। তীব্র শীতের বাতাসও তাদের দমিয়ে রাখতে পারেনি।

খুলনা পৌঁছলাম ভোর ৪টায়। আনন্দ যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেল। সকালের খাবার কখন খাবো সেই চিন্তা কারো নেই। কখন খুলনা প্রিয়জন বাস নিয়ে আসবে এটাই যেন শেষ কথা। তবে খুলনার মুন্না যে বাস নিয়ে এলো তাকে ঠিক বাস বলা ঠিক না। টেম্পো বলা যায়।

সকালের নাশতার পর মুন্নার আনা পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট বাসটায় চড়ে আমরা পৌঁছলাম মংলায়। রাস্তায় বারবার মুন্না বলছিল, রূপসা নদীর তীরে নাকি তার শ্বশুরবাড়ি। এই শুনে বি.স বললেন, এই দুনিয়ায় তিনজনের কেবল বউ আছে, একটা হলে নাঈম, আর বাকি দু’জন হলো জসিম ভাই আর মুন্না। সুন্দরবনে আমরা পৌঁছলাম বেলা ২টায়। দুটো বড় বড় ট্রলারে চড়েই গেলাম। তারপর প্রিয়জন আরিফ যে ট্রলারে উঠে সেটাই এক দিকে কাত হয়ে যায়। প্রিয়জন নজরুল ইসলাম তো ভয়েই বললেন, ভাই দয়া করে তুমি মাঝখানে বসো। নইলে সুন্দরবন আর পৌঁছতে হবে না।

সুন্দরবন পৌঁছেই সবাই ছুটতে শুরু করল। কাউকে ধরে রাখাই মুশকিল। তারপর বি.স সবাইকে নিয়ে ফটোসেশন সেরে নিলেন। দল বেঁধে সবাইকে দেখতে বললেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা! কেউ একাই ছুটে চলল। কেউ গাছে উঠে বাঘ দেখার চেষ্টা করল। কেউ হেতালগাছের সাথে হেলান দিয়ে তাল হারিয়ে ছবি তুলল। এই তালহারা কয়েক প্রিয়জন একটা মৌচাকে ঢিল ছুড়তেই যত বিপত্তি। ভ্যাগ্যিস এ যাত্রা বেঁচেছে তারা।

সুন্দরবনের মধ্যে হেঁটেচলা একটু কষ্টকর। কারণ পুরো সুন্দরবনের মাটিই শাঁসমূলে ভরা। কয়েকজন অবশ্য এই শাঁসমূল কি তাই বোঝেনি। বলল, এত ছোট ছোট গাছ কেন? ঘাস থাকলে হাঁটতে সুবিধা হতো।

কয়েক প্রিয়জন নামল গাছ শনাত্ত্ন করতে। সুন্দরী গাছ কোনটা এ নিয়ে তুমুল বিতকê শুরু হলো। একজন গোলপাতা গাছ দেখিয়ে বলল, ওটাই সুন্দরী গাছ।

বনের কিছুটা ভেতরে আমরা পেলাম হেতালগাছের ঝোপ। সবুজ সুন্দর এই দৃশ্যে সবার দৃষ্টি আটকে গেল। এখানেই বি.স টপ্পা খেলার আয়োজন করলেন। যে জিতবে সেই পাবে ফতুয়া পুরস্কার। খুলনা প্রিয়জনের হুমায়ুন কবীর ও লিনা এবং ঢাকা প্রিয়জনের কামরুজ্জামান পেল পুরস্কার। এ ছাড়া পুরস্কার জিতে নেয় শিশু প্রিয়জন মেহজাবিন বিনতে সুমাইয়া।

আমরা ফিরে এলাম সন্ধ্যায়। আসার পথে পশুর নদীর মনোরম দৃশ্য উপভোগ করলাম। এরই মধ্যে কয়েকজন দেখে এলো মংলা বন্দর। রাতে ফিরে এলাম এস এস ফাউন্ডেশনের অফিসে। সেখানে বসল আলোচনার আসর। বি.স এস এস ফাউন্ডেশনের পরিচালকের হাতে উপহারস্বরূপ তুলে দিলেন প্রিয়জন গিফট বক্স। এ ছাড়া গল্প নিয়ে আয়োজন করা হলো কুইজ প্রতিযোগিতা। এতে পুরস্কার জিতে নেন ফিহির হোসাইন ও মোঃ সাইফুল ইসলাম। পুরস্কারগুলোর সৌজন্যে ছিল নারায়ণগঞ্জের ফ্যাশন হাউজ নকশা ও ই-লিংকসের সম্মানিত ব্রোঞ্জ ম্যানেজার মাওলানা শরীফুজ্জামান জসীম।

ট্রেনের টিকিটপ্রাপ্তিতে সহযোগিতা করেন বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকা স্টেশন ম্যানেজার এম এ জিন্নাহ। প্রিয়জনের পক্ষ থেকে তাকে অনেক ধন্যবাদ।


লিখেছেনঃ ফিহির হোসাইন



No comments:

Post a Comment

Follow Us @VisitSundaebon