Sunday, April 29, 2018

ঘুরে এলাম সুন্দরবন

খুলনা ঘাট থেকে লঞ্চ ছাড়তেই মিনিট দশেকের জন্য আলী ভাই হাওয়া। খানিক বাদেই তাঁকে পেলাম লঞ্চের বারান্দায় একদম ভিন্ন পোশাকে, শিকারির পোশাক, যেন জিম করবেট। শুধু মাথার ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দলের লোগো লাগানো মেরুন রঙের টুপিটাই যা একটু বেখাপ্পা। দূর থেকে জঙ্গল দেখতে তার কাছে বায়নোকুলারটা চাইতেই আমাকে সে কী ভর্ৎসনা! ‘বুঝলা, বন্দুক ছাড়া যেমন যুদ্ধে যাওয়া ঠিক না, তেমনি বায়নোকুলার ছাড়া জঙ্গলে যাওয়া ঠিক না। কী যে কর না! আমাকে দেখো, পায়ের বুট থেকে শুরু করে চোখে সানগ্লাস, ক্যামেরা, বায়নোকুলার, টুপি-কী নাই?’

রাতে এক কেবিনে জায়গা হলো দুজনের। ‘মিলন, তোমার কাছে কি এক্সট্রা লুঙ্গি আছে? আমি আবার রাতে লুঙ্গি ছাড়া ঘুমাতে পারি না।’ মনে হলো জিজ্ঞেস করি, আলী ভাই, এত কিছু আনলেন, অথচ যেইটা ছাড়া ঘুমাইতে পারেন না, সেই জিনিসই আনলেন না? সাহস পেলাম না সে কথা বলতে। সুন্দরবন দেখতে এসে আলী ভাইকে খেপানো ঠিক হবে না। আমার কাছে নেই জেনে কয়েক সেকেন্ড কী যেন ভাবলেন, তারপর বিছানার চাদরটাকেই কোমরে জড়িয়ে নিতে নিতে বলে চলেছেন, ‘বুঝলা, লুঙ্গির মতো আরামের আর কিছু হয় না।’ বুঝেছি বলেই দোতলা বিছানায় চোখ বুজে ফেললাম তাড়াতাড়ি।

আলী ভাইয়ের মতো পর্যটকেরও যদি এমন ভুল হয়, তবে আমরা আর কী দোষ করলাম! আমাদেরও হরহামেশা এমনটা হয়। সব জিনিসই সঙ্গে নিলাম, কেবল প্রয়োজনেরটা ছাড়া। আবার অনেকে প্রয়োজনেরটা তো সঙ্গে নেয়ই, অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে ব্যাগ ভরে। আমার কথাই বলি, জীবনে প্রথম ভারতে গিয়েছিলাম তিন জোড়া জুতা নিয়ে। এর মধ্যে এক জোড়া হাই হিল সু। সে কী কষ্ট! শেষে সহযাত্রী বন্ধুকে কেডসের চেয়ে জুতাতেই বেশি ্নার্ট লাগে-এই তত্ত্ব গিলিয়ে তার কেডস দিয়ে সেবার ১৫ দিন পার করে দিলাম।

যাদের এমন বন্ধুভাগ্য আছে তাদের কথা বাদ। বাকিরা কোথাও বেড়াতে যাওয়ার আগে বসে যায় পরিকল্পনায়। কবে যাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে, আর থাকবেই বা কত দিন। যাচ্ছি বলে বেরিয়ে পড়া লোকের এতসব না ভাবলেও চলবে। তবে যারা সপরিবারে বেড়াতে যাবে, তাদের জন্য পরিকল্পনাই বেশ জরুরি। প্রথমেই আসুন যাত্রার দিনক্ষণ ঠিক করি। আমাদের দেশে পর্যটন মৌসুমটা মোটামুটি চার মাসের অর্থাৎ নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি। এর আগে-পরে এক মাস করে ধরে টেনেটুনে ছয় মাস।

এর মধ্যে দুই ঈদ আর ডিসেম্বর মাসটা বেশ জমজমাট। ডিসেম্বর মাসে অধিকাংশ স্কুলেই ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে যায় বলে বাচ্চাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ার জন্য ডিসেম্বরই সবচেয়ে ভালো। তবে এর আগে-পরে নিজেদের আর বাচ্চাদের ছুটি মিলিয়ে একটা দিন ঠিক করে ফেলুন।

এরপর আসুন, ঠিক করি কোথায় যাবেন। স্থান নির্বাচনের আগে পরিবারের সবার সঙ্গে আলাপ করে নিন। নয়তো বিপদটা আসবে অন্য দিক দিয়ে। যেমন, আপনার স্ত্রী-সন্তান খানিকটা নিরিবিলি এলাকায় বেড়াতে ভালোবাসে। অথচ আপনি তাদের নিয়ে গেলেন পিক সিজনে কক্সবাজারে। খাবার হোটেলে লাইন, সৈকত আর শহরজুড়ে মানুষজনের গিজগিজে ভিড়। ব্যস, আর যায় কোথায়! বেড়াতে এসে স্ত্রী-সন্তানের গোমড়া মুখ দেখতে কি আর ভালো লাগবে? আবার অন্য দিকটাও আছে। ধরুন, পরিবারের সদস্যরা একটু হইচই, মানুষজনের মধ্যে থাকতে ভালোবাসে, অথচ আপনি নিয়ে গেলেন বান্দরবান বা সেন্ট মার্টিন দ্বীপে।

একবার বন্ধুদের নিয়ে বান্দরবান ঘুরে সেন্ট মার্টিন গেলাম। এক বন্ধু তো ঘোষণা দিয়ে দিল যে আমার সঙ্গে আর বেড়াতে আসবে না। আমি নাকি বান্দরবানে দেখিয়েছি শুধু পাহাড় আর পাহাড়, সেন্ট মার্টিনে দেখাচ্ছি কেবল পানি আর পানি। এত পানি দেখার কী আছে? সেই গল্পটার মতো, পাহাড় বেড়িয়ে আসা এক লোককে তার বন্ধু জিজ্ঞেস করল, ‘দোস্ত, প্রকৃতি কেমন দেখলা?’ উত্তর, ‘চারদিকে খালি পাহাড় আর পাহাড়, প্রকৃতি দেখুম কেমনে?’ বুঝুন অবস্থা।

বেড়ানোর জায়গা ঠিক হয়ে গেল। এবার বসুন বাজেট নিয়ে, মানে টাকা-পয়সার হিসাব নিয়ে। কোথায় যাবেন, কতজন যাবেন, কেমন হোটেলে থাকবেন-খুঁটিনাটি সবকিছুই মাথায় রাখতে হবে। মনে রাখবেন, বেড়াতে গিয়ে এক গ্লাস বিশুদ্ধ পানি খেতেও গাঁটের পয়সা গুনতে হবে। একেকবার বেড়িয়ে এসে ঘরে খেতে বসলেই মনের মধ্যে হিসাব চলে আসে। ভাত ২০ টাকা। মাংস ৭০ টাকা, ডাল ১০ টাকা ইত্যাদি। ডুবো ডালে ভাত খাওয়ার বিলাসিতাটা এখন ঘরেই করি। সে যা-ই হোক, বেড়ানোটা যেহেতু খরচের ব্যাপার, একটা কাজ করা যেতে পারে। পরিবারের সবাই মিলে একটা বেড়ানোর ব্যাংক করতে পারেন। প্রতিজন সদস্য প্রতিদিন টাকা জমাবেন। ভাবুন, কেবল আপনিই যদি প্রতিদিন ১০ টাকা করে জমান, তবে বছর শেষে আপনার জমার পরিমাণ হবে কম করে হলেও তিন হাজার ৬০০ টাকা। আর এই টাকা দিয়ে বাংলাদেশের যেকোনো স্থানে চার-পাঁচ দিন বেড়িয়ে আসতে পারবেন তার গ্যারান্টি দিচ্ছি। স্কুলপড়ুয়া সন্তানদেরও উদ্বুদ্ধ করুন এ কাজে। দেখবেন, কেমন উৎসাহ নিয়ে নেমে পড়ে। আর নিজের টাকায় ঘুরে বেড়ানোর মজাই আলাদা। অনেকে দল বেঁধে বেড়াতে ভালোবাসে। এতে সুবিধা যেমন আছে, তেমনি অসুবিধাও আছে। সুবিধা হলো, এতে বেড়ানোর খরচ বেশ খানিকটা কমে যায়। শেয়ার করে থাকতে পারলে হোটেল খরচ বাঁচানো যায়। গাড়ি ভাড়া আর খাবার খরচ তো আছেই। আর দলের সবাই যদি মোটামুটি সমমনা না হয়, তবেই বিপত্তি।

সেই সুন্দরবন ভ্রমণেরই এক সন্ধ্যায় লঞ্চের টিভি রুমে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ওপর ডিসকভারি চ্যানেলের একটা প্রোগ্রাম দেখছিলাম। পাশে বসা সহযাত্রী কানে কানে বললেন, ‘সুন্দরবনের বাঘগুলো মেরে ফেলা উচিত। দেখেন না, কেমন ধরে ধরে হরিণ মেরে শেষ করে দিচ্ছে?’ বাকি তিন দিন লোকটাকে এড়িয়ে চলেছিলাম। তাই সঙ্গী নির্বাচনে কৌশলী হোন।

মোশতাক আহমেদ, টিপু সুলতান আর আফজাল হোসেন-এই তিনজন কাজ করেন এক বেসরকারি ব্যাংকে। মাসখানেকের পরিকল্পনা শেষে তিন পরিবারের মোট ১৩ জনের দল নিয়ে পৌঁছালেন কলকাতায়, রোজার ঈদের পরপরই। বিপত্তি বাধল তার পর। একে দুর্গাপূজা, তার ওপর ১৩ জনের বিশাল দল। হোটেলে রুম পাওয়া গেলেও কিছুতেই জোগাড় করতে পারলেন না দিল্লি যাওয়ার ট্রেনের টিকিট। এক ট্রেনে এক কম্পার্টমেন্টে এতগুলো টিকিট অতিরিক্ত টাকা দিয়ে পেলেন না। প্লেনের টিকিট কাটতে গিয়েও একই ব্যাপার। খাবার হোটেলে ১৩টি খালি চেয়ার পাওয়া, বেড়াতে গিয়ে তিনটি খালি ট্যাক্সি, নিক্কো পার্কের ১৩টি টিকিট-সব মিলিয়ে ১৩ সংখ্যাটি খুব একটা সুখকর ছিল না দলটির কাছে। শেষে দিল্লি, জয়পুর, আগ্রা বেড়ানোর পরিকল্পনা বাদ দিয়ে কলকাতার নিউমার্কেট, গড়িয়াহাটে শপিং করে ফিরে আসেন তাঁরা। তাই দল বেঁধে গেলেও তা চার-পাঁচের মধ্যে থাকলেই ভালো। তবে কোনো ট্যুরিজম প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্যাকেজ ট্যুরে গেলে ভিন্ন কথা।

চলুন, শুরু করে দিই বেড়ানোর আয়োজন পরিবারের সবাইকে নিয়ে। দেশে বেড়ে উঠুক পারিবারিক ভ্রমণের সংস্কৃতি। আর যদি হঠাৎ করেই চলে আসে কোথাও বেড়ানোর সুযোগ, হাতছাড়া করবেন না মোটেও। আরে এতকিছু ভেবে কি আর ঘুরতে যাওয়া যায়? ‘যাচ্ছি’ বলে বেড়িয়ে পড়ুন তো, গোল্লায় যাক উপদেশমালা।



লিখেছেনঃ ফখরুল আবেদীন মিলন

No comments:

Post a Comment

Follow Us @VisitSundaebon