Wednesday, April 25, 2018

সুন্দরবনঃ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সম্পর্কে কিছু তথ্য - ০৮

হরিণঃ

সুন্দরবনের কথা মনে হলেই সুন্দরবনের হরিনের কথা মনে পড়ে যায়। অপুর্ব সুন্দর, টানা টানা চোখ, মায়াবী চাহনি, গুনে গুনানি¦ত সুন্দরবনের হরিণ মানুষের মনকে এক পলকে কেড়ে নেয়। সুন্দরবনে দু-ধরনের হরিণ আছে যথা চিত্রল হরিণ ও মায়া হরিণ। বন্য প্রাণীর সংখ্যার দিক দিয়ে সুন্দরবনে হরিণের সংখ্যা বেশী।

চিত্রল হরিণঃ

মায়াবী চিত্রল হরিণ সুন্দরবনের সর্বত্র বিচরণ করে। তবে সর্বত্র এদের প্রচুর দেখা যায় না। কটকা, কচিখালী, নীলকমল, কালিরচর, মান্দারবাড়িয়া ইত্যাদি এলাকায় প্রায়ই খুব কাছ থেকে হরিণ দেখা যায়, যা পর্যটকদের প্রচুর আনন্দ দেয়। দ্রুত গতির এ হরিণগুলো বেঙ্গল টাইগারের প্রধান খাদ্য। এই হরিণ ও বানরের মধ্যে একটি সুন্দর সম্পর্ক রয়েছে। করমজল দর্শনার্থী কেন্দ্রে বেশ কিছু চিত্রল হরিণ দর্শনার্থীদের আনন্দ দেবার জন্য বেড় দিয়ে ঘিরে রাখা আছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভৃমি সুন্দরবনের চিত্রা হরিণ পৃথিবী বিখ্যাত।

সুন্দরবনের মত আর কোন স্থানে এক সাথে এত বেশি চিত্রা হরিণ দেখা যায় না। চিত্রা হরিণের গা সাদা কালো ফোঁটা দ্বারা চিত্রিত। লালচে বা বাদামী চামড়ার উপর সাদা ফোঁটার সমাহার হরিণের সৌন্দর্যকে অনুপম করে তুলেছে। চিত্রা হরিনের হাত, পা, পেট সমস্ত শরীওে সাদা সাদা ছোট বড় ফোঁটা আছে। গলা বেশ ধবধবে সাদা। গায়ের সাদা ফোঁটার সমাহার সুন্দর দেখা যায়। যে সব হরিণের শিং আছে সেগুলো হলো পুরষ হরিণ। অনেক সময় স্থানীয়ভাবে এদের শিংগেল হরিণও বলা হয়। পুরুষ হরিনের শিং গুলো বড় এবং ডাল পালা থাকায় খুব সুন্দর দেখায়। শিং বিহীন চিত্রা হরিণ হলো মহিলা হরিণ। চিত্রা হরিণ দলবদ্ধ ভাবে চলাফেরা করতে ভালবাসে। এদের এক দলের মধ্যে হরিণ শাবক থেকে শুরু করে ছোট বড় বিভিন্ন সাইজের ও বয়সের হরিণ থাকে। হরিণ সাধারণ স্যাতস্যাতে ও ঠান্ডা জায়গায় বসবাস করতে ভালবাসে। এরা রাতের বেলায় পরিস্কার এবং অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় ঘুমায়। হরিণের ঘুমানোটাও একটু অদ্ভুদ ধরনের। এরা দল বদ্ধ ভাবে বৃত্তাকারে ঘুমায়। বাঘের হাত হতে রক্ষার জন্য ঘুমানোর সময় এদের মাথা গুলো চারিদিকে থাকে এবং পেছনটা একত্রে থাকে।

সুন্দরবনে প্রায় ৮০ হ্জার চিত্রা হরিণ আছে। সুন্দরবনের যে সব এলাকায় প্রচুর ঘাস ও কেওড়া বন রয়েছে সেসব এলাকায় চিত্রা হরিণের জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র আর কেওড়া পাতা হরিণের প্রিয় খাদ্য। চিত্রা হরিণ মূলত ঘাস খেয়ে জীবন ধারণ করে। ঘাস পাওয়া না গেলে গাছের কচি পাতা খায়। সুন্দরবনের চিত্রা হরিণ চরে জেগে উঠা কচি দুর্বা ঘাস, নলখাগড়া, উলুঘাস, মালিয়া ঘাস, বাউড়ি ঘাস খেতে বেশী পছন্দ করে। তাছাড়া তারা বাইন, গেওয়া, গরাণ, গর্জন, কাকড়া গাছের চারা, পাতা ও ছাল খায়।

হরিনের শিং এ ৩/৪টি ডাল থাকে। এদের শিং প্রতি বছর নতুন করে গজায়। বৈশাখ -জ্যৈষ্ঠ মাসে পুরাতন শিং পড়ে যায় এবং নতুন শিং গজায়। সাধারণ প্রজনন শেষে এদের শিং পড়ে যায়। পুরুষ চিত্র হরিণ এপ্রিল ও জুন মাসে সর্ব্বোচ্চ প্রজননের সময়। তখন এরা মহিলা হরিনের সাথে দলে দলে চলে। পুরুষ হরিণ আকৃতিতে মহিলা হরিনের চেয়ে বেশী বড় এবং ঘাড় ও গর্দান মোটা হয়। চিত্রা হরিণ উচ্চতায় ৩ ফুট হয়। ওজনের দিক দিয়ে একটি চিত্রা হরিণ ১ মণ হতে ৩ মণ পর্যন্ত হয়ে থাকে। চিত্রা হরিণ ১০ থেকে ১৫ বছর বেঁচে থাকে। হরিণ বছরে একবার বাচ্চা প্রসব করে। চিত্রা হরিনের বয়স ৯ মাস হতে ১ বছরের মধ্যেই এরা মা হবার যোগ্যতা অর্জন করে থাকে। এদের গর্ভধারণ সময় ৬-৭ মাস। প্রতি বাবে একটির বেশী বাচ্চা প্রসব করতে দেখা যায় না।

মায়া হরিণঃ

চিত্রা হরিণের পাশাপাশি সুন্দরবনে রয়েছে অসংখ্য মায়া হরিণ। ছোট আকারে লালচে বাদামী পিংগল রং এর ফোটা বিহীন এ হরিনের চলাফেরা ও জীবন ধারণ খুবই চমৎকার। ভয় পেলে মায়া হরিণ অনেকটা কুকুরের মত ঘেউ ঘেউ করে বলে এদের বার্কিং ডিয়ার বলে। সুন্দরবনের একটা পরিপক্ক মায়া হরিণের গড় ওজন ১৭ কেজি হয়। পুরুষ হরিণের উপরের চোয়ালের কেনিন দাত খুব বড় এবং দুর থেকে তা স্পষ্ট ভাবে দেখা যায়। সুন্দরবনের উত্তরাংশে মায়া হরিণ বসবাস করে। দক্ষিণ অংশে সমুদ্র উপকুলে এদের দেখা যায় না। চাঁদপাই রেঞ্জের করমজল, জোংড়া, ঢাংমারী বনাঞ্চলে মায়া হরিণ অবাধে বিচরণ করতে দেখা যায়।

সুন্দরবনে প্রায় ৩০ হাজার মায়া হরিণ আছে। মায়া হরিণ সাধারণত ৩ ফুট লম্বা হয়। উচ্চতা ১ ফুট ৮ ইঞ্চির মত এবং লেজ ৭ ইঞ্চির মত হয়। মায়া হরিণের শিং প্রায় ৬ ইঞ্চি লম্বা হয়। মারা হরিণ তৃণ ভৃমির প্রাণী নহে। মায়া হরিণ একা চলতে ভালবাসে। তবে ২টি মায়া হরিণ একত্রে বিচরণ করতে বিরল দেখা যায়। কখনো কখনো মহিলা ও মায়া হরিণের বাচ্চা বা মহিলা ও পুরুষ হরিণ এক সাথে দেখা যায়। মায়া হরিণ বছরের যে কোন সময় প্রজনন সক্ষম। তবে শীতকালে ডিসেম্বর/জানুয়ারী মাসে মায়া হরিণের প্রধান প্রজনের সময়। এর গর্ভধারণ কাল ছয় মাস। বর্ষার শুরুতে বাচ্চা প্রসব করে। মায়া হরিণ পোষ মানানো যায়। মায়া হরিণ ভোরে এবং গোধুলীতে ঘাস ও তৃনলতা খায়। বনের মাঝে বা ধারে ঘাস বহুল জায়গায় এরা থাকতে বেশী পছন্দ করে।

কুমিরঃ

সুন্দরবনের যে সব বন্যপ্রাণী ভ্রমনকারীদের মন আকর্ষণ করে, ভ্রমনকে সার্থক ও আনন্দময় করে তুলে তার মধ্যে কুমির উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রাখে। পর্যটকরা সুন্দরবন ভ্রমনের সময় কুমির দেখার জন্য খুব ব্যস্ত হয়ে যায়। তারা চলার পথে ট্রলার, লঞ্চ থেকে অবলোকন করতে থাকে। চলতে চলতে হঠাৎ যখন দেখলো যে একটা কুমির নদীর পাড়ের চরে বিশ্রাম নিচ্ছে, রোদ পোহাচ্ছে তখন তারা সংগীদের দেখানো ও ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। হাকা হাকি, লঞ্চ ও ট্রলার এর বিকট শব্দে ক্ষনিকের জন্য প্রাকৃতিক নির্জনতা হারিয়ে কুমিরের তন্ময় ভাবকে আঘাত করা মাত্র লাফ দিয়ে নদীর অতলে হারিয়ে যায়। এ বিরল দৃশ্য উপভোগ করা সৌভাগ্যের বিষয়।

সুন্দরবনে সর্বত্র কুমির আছে। তবে বিশেষ বিশেষ স্থানে এদের বেশী চলাফেরা করতে দেখা যায়। সুন্দরবনের যে সব স্থানে প্রতিনিয়ত কুমির দেখা যায় সে গুলো হল নন্দবালা খাল, পশুর নদীর চর, শেলা গাং, ঝোংড়া খাল, শাফলা খাল, ভদ্র্ গাং, মরাভোলা নদী, পাথরিয়া গাং, আরাইবেকি খাল প্রভৃতি। সুন্দরবনে কতটি কুমির আঝে তার কোন হিসেব এখনও পাওয়া যায়নি। সুন্দরবনের জলভাগের পরিমান হল ১৭০০ বর্গ কিলোমিটা। এর মধ্যে অনেক কুমির আছে তা বলা যায়। সুন্দরবনে কুমির দেখার উপযুক্ত সময় হলো শীত মৌসুম। এ সময় রোদ পোয়ানোর জন্য কুমির নদীর চর বা খালের পাড়ে উঠে মাটিতে শুয়ে থাকে। সাধারণতঃ সকালের দিকে ভাটার সময় কুমির নদী বা খালের পাড়ে রোদ পোয়ায়। বিকেলেও ভাটা থাকলে কুমিরকে নদী বা খালের পাড়ে বিশ্রামরত অবস্থায় দেখা যায়।

সুন্দরবনে সাধারণত লোনা পানির কুমির দেখা যায়। এ কুমির প্রায় ১৫-২০ ফুট লম্বা হয়। দেখতে কালো বা হলুদা ভাব। কুমিরের দুটি হাত, ২টি পা, একটি চোয়াল ও একটি লেজ আছে। কুমিরের মাথা খুব লম্বা। চোয়ালের অগ্রভাগের উপরে নাসারন্ধ্র, মাথার উপর দু’ পাশে দু’ টি চোখ ও চোখের পিছনে ঢাকনা যুক্ত কানের ঝিল্লি। কুমিরের শরীর কাটা যুক্ত। কাটা গুলো বর্মের ন্যায় কাজ করে। কমির যেমন পানিতে বাস করতে পারে তেমনি ডাংগায়ও বাস করতে পারে। কুমির দু’ হাত ও দু’ পা ভর দিয়ে বুক ও পেট উঁচু করে ডাংগায় চলাফেরা করে।

সুন্দরবনের কুমির প্রধানত মাছ খেয়ে জীবণ যাপণ করে। মাছের মধ্যে ভেটকি, পাংগাস, দাতিনা প্রভৃতি উল্লেখ্য যোগ্য মাছ তারা ধরে খায়। ডাংগায় সুবিধামত বন মোরগ, বাঘ, হরিণ, বানর ইত্যাদি পেলে শিকার করে খায়। তা ছাড়া গরু মহিষ মরাও খায়। নদীতে সাতার কাটার সময় এরা লেজ ব্যবহার করে। এবং হাত ও পা গুটিয়ে রাখে। পানির নিচে ডুব দিয়ে এক স্থান হতে অন্য স্থানে যেতে পারে। পানিতে ভাসার সময় হাত পা ছাড়িয়ে ভেসে থাকে। কুমিরের সব দাত সমান। শিকারের সময় দাত দিয়ে শিকারকে মেরে ফেলে। কুমির লেজ এবং দাঁত যুক্ত চোয়াল দিয়ে আক্রমন করে। লেজ দিয়ে আঘাত করে শিকারকে ধরে ফেলে। শিকার বড় হলে পানির উপর ছুড়ে আবার হা করে গিলে ফেলে। এ দৃশ্য উপভোগ করার মত।

সুন্দরবনের কুমির ডিসেম্বর-জানুয়ারী মাসে ডিম পাড়ে। নদীর পাড়ের পার্শ্ববতী বালুর চর অথবা বনের মধ্যে গর্ত করে ডিম পাড়ে। অনেক সময় গর্ত না করে গোলপাতা দিয়ে বাসা তৈরী করে ডিম পাডে। ডিম পাড়ার পর গর্ত মাটি দিয়ে ঢেকে দেয়। গর্ত ২-৩ ফুট গভীর হয়। গোলপাতার বাসায় ডিম পাড়লে আবার পাতা দিয়ে ঢেকে দেয়। একবারে ২০-৩০ টি ডিম পাড়ে। ডিম পাড়ার পর মা কুমির একটু দুরে থেকে ডিমের দিকে দৃষ্টি রাখে। এভারে প্রায় ৫০-৬০ দিন হলে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। গর্তে ডিম পাড়লে মা কুমির খুব সতর্ক অবস্থায় থাকে। ডিম ফোটার সময় হলে কুমিরের বাচ্চার প্রথমে চোয়াল হয়। সেই চোয়াল দিয়ে ডিমের প্রাচীর ভাঙ্গার জন্য ঠুকুর দিলে টুন টুন আওয়াজ হয়। গর্তের ভিতরে যখন মা কুমির টুক টুক আওয়াজ শুনতে পায় তখন মাটি খুড়ে বাচ্চা বের করে।

কুমির ছানা গর্ত হতে বের হওয়ার পর দৌডিয়ে পাশ্ববর্তী পানিতে লাফিয়ে পড়ে। অথবা মায়ের পিঠে চড়ে পানিতে আসে। এভাবে ৫-৭ সপ্তাহ মা কুমির তার বাচ্চা চিনতে পারে। পরবর্তীতে আর চিনতে পারে না। তখন পুরুষ অথবা স্ত্রী কুমির বাচ্চা খেয়ে ফেলে। কুমির ৫০-৬০ বছর বেঁচে থাকে। সুন্দরবনের কুমির খুব ভয়ংকর প্রাণী। সময় ও সুযোগ পেলে এরা মানুষ এমনকি বাঘও খেয়ে ফেলে। কুমিরের মুখ ও পেট অনের বড়। এরা ইচ্ছে করলে একটা আস্ত মানুষ বা বাঘ একেবারে গিলে পেটে ভরে রাখতে পারে।

-চলবে

No comments:

Post a Comment

Follow Us @VisitSundaebon