প্রাণীকুল : বাংলাদেশের মধ্যে সুন্দরবনই বন্যপ্রাণীর বৃহত্তম আবাসস্থল। এখানে ৩৭৫ প্রজাতির অধিক বন্যপ্রাণী আছে, যার মধ্যে ৩৫ প্রজাতির সরিসৃপ, ৩১৫ প্রজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী অন্তর্ভুক্ত। ২৯১ প্রজাতির মধ্যে ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাকড়া এবং ৭৩ প্রজাতির মলাস্কা সুন্দরবনে বিদ্যমান। সুন্দরবনের প্রধান প্রধান বন্য প্রাণীর মধ্যে রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল হরিণ, বন্য শুকর, বানর, নোনা পানির কুমির, অজগর, কচ্ছপ, ডলফিন, উদবিড়াল,মেছো বিড়াল, বন বিড়াল এবং বিভিন্ন প্রজাতির পাখি।
সুন্দরবনের মৎস্য সম্পদ : বঙ্গোপসাগরের সবচেয়ে বড় মৎস্য ভান্ডার সুন্দরবন সংলগ্ন জলভাগে। সমগ্র সুন্দরবনের ৩১.১৫% এলাকা জুড়ে রয়েছে বিশাল জলভাগ। বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদের উৎস এ সুন্দরবনের বৃহৎ অংশ জুড়ে রয়েছে মৎস্য সম্পদ।সুন্দরবন এবং সুন্দরবণ সংলগ্ন উপকুলীয় এলাকায় প্রায় ৪০০ এর অধিক মৎস্য প্রজাতির মাছের অস্তিস্ব পাওয়া যায়। যার মধ্যে ১২০ প্রজাতির মাছ জেলেরা বাণিজ্যিকভাবে সংগ্রহ করে থাকে। সুন্দরবনের উল্লেখযোগ্য মৎস্য প্রজাতিগুলো হলো-ইলিশ,ভেটকি, রূপচাঁদা, দাতিনা, কাইনমাগুর,পাঙ্গাস,লইট্যা, ছুরি, মেদ, পারসে, পোয়া, তপসী ইত্যাদি। প্রতি বছর সুন্দরবনের জলভাগ হতে আহরিত হয় শত শত মেট্রিক টন সাদা মাছ, বাগদা চিংড়ি, শুকড়ি মাছ এবং কাকড়া, যা বিদেশে রপ্তানী করে বাংলাদেশ প্রচুর পরিমানে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে থাকে। সুন্দরবনের মৎস্য সম্পদকে কেন্দ্র করে একদিকে যেমন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অপরদিকে দেশের জনগনের প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে সুন্দরবন অগ্রণী ভৃমিকা পালন করে চলেছেঅ বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মংস্য আহরণ সংক্রান্ত উপাত্তের সাথে তুলনায় দেখা যায় যে,দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকুলীয় অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি পরিমান মৎস্য আহরিত হয়। শুধুমাত্র সুন্দরবনেই প্রায় ৪০,০০০ টি জেলে নৌকা মাছ ধরার জন্য বনে প্রবেশ করে। সুন্দরবন সংলগ্ন খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলাতে বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ চিংড়ি ও কাঁকড়া উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা গড়ে উঠেছে। সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ বনের কারনেই অত্র অঞ্চলে চিংড়ি উৎপাদন সম্ভব হয়। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ প্ররিবেশ সংরক্ষন এবং মাছের উৎপাদন অব্যাহত রাখার স্বার্থে বন বিভাগের পক্ষ হতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, যেমন-সুন্দরবনের অভ্যন্তরে তিনটি বন্যপ্রাণী অভয়ারন্য এলাকাতে মৎস্য শিকার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য কেন্দ্রের বাইরে ১৮টি খালেও সারা বছরই মৎস্য শিকার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সুন্দরবনের অভ্যন্তরে চিংড়ির পোনা ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জানুয়ারী এবং ফেব্র“য়ারী মাসে কাঁকড়া ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সুন্দরবনের বাঘ ঃ বাঘ শুমারী, ২০০৪ হতে দেখা যায় সুন্দরবনে মোট ৪৪০ টি বাঘ আছে। যার মধ্যে ২১টি ব্যাঘ্র শাবক রয়েছে। গড়ে সুন্দরবনের প্রতিটি বাঘের জন্য ১৪.৪ বর্গ কিঃমিঃ ব্যাপী নিজস্ব আবাস স্থল রয়েছে। সুন্দরবনের বাঘের উপর গবেষণার অংশ হিসাবে ২টি বাঘিনী ( যাদের নাম জামতলার রাণী এবয় ছাপড়াখালীর রাণী) এর গলায় রেডিও কলার পরানো হয় এবং তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষন করা হয়। গবেষণায় দেখা যায় উভয় বাঘিনীরই হোম রেঞ্জ প্রায় ১৪ হতে ১৬ বর্গ কিঃমিঃ যা বিশ্বের অন্যান্য বনাঞ্চলের বাঘের হোম রেঞ্জের তুলনায় সবচেয়ে কম।এই গবেষনার পুর্বে বাঘের সবচেয়ে ছোট হোম রেঞ্জ পাওয়া যায় নেপালে, যা প্রায় ২৫ হতে ৩০ বর্গ কিঃমিঃ এবং সবচেয়ে বড় হোম রেঞ্জ পাওয়া যায় রাশিয়াতে যা ৪০০ বর্গ কিঃমিঃ এর অধিক। গবেষনার এ ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায় সুন্দরবনেই বাঘের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশী যা সুন্দরবনে বাঘের প্রজনন বৃদ্ধি এবং টেকসই বিচরণ ক্ষেত্রের উপযুক্ততা প্রমান করে।
সুন্দরবন সংরক্ষণ প্রচেষ্টা : সুন্দরবনের জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষনের জন্য ৩টি অভয়ারণ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ, বংশ বিস্তার ও নিরাপত্তা প্রদানের উদ্দেশ্যে বনের নির্দিষ্ট অংশ যেখানে প্রাণী ও বৃক্ষের বৈচিত্রময় সমাহার ঘটেছে সে এলাকাগুলোকে অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষনা করা হয়েছে। অভয়ারণ্য এলাকায় সকল প্রকার বনজদ্রব্য আহরণ ও মাছ ধরা সম্পর্ণভাবে নিষিদ্ধ। বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ সংরক্ষনের জন্য প্রতিষ্ঠিত ৩টি অভয়ারন্য কেন্দ্রের মোট আয়তন ১,৩৯,৭০০ হেঃ যা সমগ্র সুন্দরবনের প্রায় ২৩%। নিম্নে অভয়ারণ্য এলাকাগুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হলোঃ
সুন্দরবন পুর্ব অভয়ারণ্য : ৪ ,৫ ,৬নং কম্পার্টমেন্টের সমগ্র এলাকা এবং ৭নং কম্পার্টমেন্টের আংশিক এলাকাসহ ৩৯,২২৭ হেঃ আয়তন নিয়ে এ অভয়ারণ্য এলাকা বিস্তৃত যার মধ্যে আছে ২২,৫৭৫ হেক্টর স্থলভাগ এবং ৮,৬৫২ হেক্টর জলভাগ। উত্তরে আরজবাণী, বাকী খাল ও সুপতি খালের কিছু অংশ, পুর্বে বলেশ্বর নদী, পশ্চিমে বেতমোর ও চানা বেতমোর নদী এবং দক্ষিনে বঙ্গোপসাগর দ্বারা এ অভয়ারণ্য এলাকা সীমাবদ্ধ। সদর দপ্তর কটকা।
সুন্দরবন দক্ষিণ অভয়ারণ্য : ৪৩ ও ৪৪ নং কম্পার্টমেন্টের সমগ্র এলাকা নিয়ে প্রায় ৩৬,৯৭০ হেক্টর আয়তনের এ অভয়ারণ্য এলাকা গঠিত, যার মধ্যে ২১,০০০ হেক্টর স্থলভাগ এবং বাকী অংশ জলভাগ। উত্তরে কাগা নদী এবং দোবেকী খাল, পুর্বে কাগা ও মরজাত নদী, পশ্চিমে মালঞ্চ ও বড় পাংগাসিয়া এবং পুতনিচর ও বঙ্গোপসাগর দ্বারা এ অভয়ারণ্য সীমাবদ্ধ। সদর দপ্তর নীলকমল।
সুন্দরবন পশ্চিম অভয়ারণ্য : কম্পার্টমেন্ট নং-৫৩, ৫৪, ৫৫ এর সমগ্র এলাকা এবং ৪৯নং কম্পার্টমেন্টের অংশ বিশেষ নিয়ে সুন্দরবন পশ্চিম অভয়ারণ্য গঠিত। উত্তরে বুড়ির গাং,ইলিশামারী ও যমুনা নদীর সংযোগ্রল, পুর্বে যমুনা নদী, পশ্চিমে হরিণভাঙ্গা নদী ও দক্ষিণ তালপট্রি দ্বীপ ও বঙ্গোপসাগর দ্বারা এ অভয়ারণ্য এলাকা সীমাবদ্ধ। এ অভয়ারণ্য এলাকার মোট আয়তন ৭১,৫০২ হেক্টর স্থলভাগ এবং ২৪,১৪৮ হেক্টর জলভাগ। সদর দপ্তর নোটাবেকী।
বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা : জাতিসংঘের ইউনেস্কো কমিশন সুন্দরবনের তিনটি অভয়ারণ্যকে ১৯৯৭ সনের ৬ই ডিসেম্বর ৭৯৮ তম বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা হিসেবে ঘোষনা দেয়। তৎকালীণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ৪ ফ্ব্রে“য়ারী ১৯৯৯ সনে বিশ্ব ঐতিহ্যের ফলক উম্মোচন করেন। তিনটি অভয়ারণ্য অঞ্চল নিয়ে গঠিত বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকার মোট আয়তন ১,৩৯,৭০০ হেক্টর। সুন্দরবনের জীব বৈচিত্র সংরক্ষন ও উন্নয়নে ইউনেস্কো সাহায্য সহযোগীতা প্রদান করবে বলে আশা করা যায়।
রামসার এলাকা : ৬,০১৭ বর্গ কিঃমিঃ আয়তনের সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপ এবং দীর্ঘতম লবনাক্ত জলাভূমি। জীব বৈচিত্রে সমুদ্ধ সমৃদ্ধ সুন্দরবন বিশ্বের মধ্যে একটি অতি গুরুত্বপুর্ন ইকোসিষ্টেম। এখানে ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ এবং ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী বিদ্যমান, যার মধ্যে আছে ৩৫ প্রজাতির সরিসৃপ, ৩১৫ প্রজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং বিশ্ব বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার। প্রধান সরিসৃপ প্রজাতির গুলোর মধ্যে আছে নোনা কুমির, অজগর, গোখরা, গুইসাপ, সামুদ্রিক সাপ, গিরগিটি, কচ্ছপ এবং অন্যান্য। কমপক্ষে ৩০ প্রজাতির সাপ সুন্দরবনে পাওয়া যায়। কিন্তু গত ১৫ বছরে এই সমস্ত সাপের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেয়েছে। এদের মধ্যে অনেকগুলোকে সচরাচর দেখতে পাওয়া যায় না। পাথুরে অজগরকে অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন প্রজাতির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। জলাভূমি হিসাবে রামসার এলাকার সমস্ত বৈশিষ্ট বিদ্যমান থাকায় সুন্দরবনকে ১৯৯২ সালে ৫৬০ তম রামসার এলাকা হিসেবে ঘোষনা করা হয়েছে।
-চলবে
No comments:
Post a Comment