Sunday, April 29, 2018

সুন্দরবনঃ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সম্পর্কে কিছু তথ্য - ১১

সারা বছর মাছ ধরাঃ সুন্দরবনে সারা বছর জেলেরা মাছ ধরে। তারা প্রথমে ষ্টেশন অফিষ হতে বিএলসি (বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট) করে। বিএলসি করতে ফটো, নৌকা ও চেয়ারম্যান বা মেম্বারের পরিচয় পত্র লাগে। নৌকা যত বড় হবে বিএলসি করতে তত বেশী টাকা লাগে। তবে সুন্দরবনে সারা বছর যে সব জেলেরা মাছ ধরে তাদের নৌকা গুলো বেশী বড় হয় না। বেশির ভাগ নৌকাই ২৫ থেকে ১৫০ মনের হয়। প্রতি ২৫ মনের জন্য বিএলসি করার সময় নির্ধারিত ফিস জমা দিতে হয়। বিএলসি করার সময় যার নামে বিএলসি হবে ঐ ব্যক্তিকে নৌকা ও সব কাগজপত্র নিয়ে ষ্টেশন অফিসে যেতে হয়। ষ্টেশন অফিসার নৌকা ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র দেখে সন্তুষ্ট হলে বিএলসি ইস্যু করেন।

বিএলসি করার পর জেলেরা ষ্টেশন হতে মাছের পাশ করে। প্রতিটি পাশ ৭(সাত) দিনের জন্য ইস্যু করা হয়। জেলেরা ইচ্ছা করলে ১৫ দিনের জন্য পাশ করতে পারেন। পাশ করার সময় প্রতি পাশে সহযোগী জেলে ২-৩ জন থাকে। প্রত্যেক জেলেকেই পাশ করার সময় সপ্তাহ বা আংশিক সপ্তাহের জন্য বনের অবস্থান কর অগ্রিম জমা দিতে হয়। মাছ ধরার পর যে ষ্টেশন হতে পাশ করা হয়েছে সেখানে পাশ জমা দিতে হয় এবং যে পরিমান মাছ ধরা হয় সে পরিমান মাছের রাজস্ব জমা দিয়ে সিটি (সার্টিফিকেট অব ট্রান্সফার) সংগ্রহ করতে হয়। তবে মাছ কম পেলেও প্রতিজন প্রতিদিন তিন সের হিসেবে মাছের রাজস্ব জমা দিতে হয়। তন্মধ্যে ১০% চিংড়ি মাছের রাজস্ব জমা দিতে হয়।

সুন্দরবনে মাছ ধরতে জেলেরা বাড়ি থেকে চাউল, ডাল, তরিতরকারী নিয়ে যায়। নৌকায় থাকার জন্য তাদের প্রয়োজনীয় বালিশ ও কাথা থাকে। পাক করার জন্য সামান্য সরঞ্জামাদি থাকে। বন থেকে শুকনা জ্বালানী সংগ্রহ করে তারা ভাত রান্না করে খায়। নদী থেকে যে মাছ পায় তা থেকে কিছু তারা পাক করে খায়। জেলেদের খাওয়া দাওয়া খুবই সাধারণ। ভাত আর একটা মাছের তরকারী হলেই যথেষ্ট। নৌকার মধ্যে জেলের জীবন ধারণ বেশ বেশ কষ্টসাধ্য। নৌকায় একটা ছোট ছৈ থাকে। ঝড়-বাদল সহ্য করে তারা এ স্বল্প পরিসরে থাকে। এক দিকে বাঘ ও কুমিরের ভয় অন্য দিকে ডাকাতের ভয়। অনেক সময় পায়খানা করতে বনে গেলে বাঘে ধরে নিয়ে যায়। জেলেরা নদীতে গোসল করে। এ সময় কুমিরের ভয় থাকে।

জেলেরা সারা বছর ধরলেও তারা ভরা এবং মরা গোনের উপর নির্ভর করে সুন্দরবনে মাছ ধরতে যায়। মাসে দু’ বার ভরা গোন হয় এবং দু’ বার মরা গোন হয়। প্রতি পুর্নিমায় একবার ভরা গোন ও একবার মরা গোন হয়। তেমনি প্রতি অমাবশ্যায় একবার ভরা গোনও একবার মরা গোন হয়। ভরা গোন সপ্তমী থেকে শুরু করে একাদশী পর্যন্ত থাকে। আর মরা গোন দ্বাদশী থেকে শুর করে ষষ্ঠী পর্যন্ত থাকে। ভরা গোনে সমুদ্র হতে বেশী পরিমানে লোনা পানি সুন্দরবনে ঢুকে। এ সময় বনের ভিতর পানি ঢুকে। ভরা গোনে জোয়ারের গতি অনেক বেশি থাকে। তখন সমুদ্র হতে অনেক মাছ এ পানির সাথে সুন্দরবনে ঢুকে। তাই ভরা গোনে জেলেরা অনেক মাছ পায়। সুন্দরবন পরিদর্শনের সময় বনের অভ্যন্তরে বেশি জেলে মাছ ধরা অবস্থায় দেখা গেলে বুঝতে হবে যে ভরা গোন চলছে। যদি জেলে কম দেখা যায় অথবা জেলেরা বাড়িতে চলে যাচ্ছে এরূপ অবস্থা পাওয়া যায় তখন বুঝতে হবে যে গোন শেষ। সামনে মারা গোন আসছে।

সুন্দরবনের ভিতরে জেলেরা দলবদ্ধ হয়ে মাছ ধরে। যেখানে জেলে দেখা যাবে সেখানে কমছে কম ১৫-২০ টি নৌকায় মাছ ধরা অবস্থায় পাওয়া যাবে। দিনের বেলা যে যেখানেই মাছ ধরুক না কেন রাতের বেলা জেলেরা কোন বন অফিসের কাছে নোংগর করে থাকে। ডাকাতদের হাত হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা এরূপ করে। সুন্দরবনে বিভিন্ন ধরনের জেলে আছে। যেমন ভেটকি, খান মাগুর ইত্যাদি মাছ ধরার জেলে, চিংড়ি মাছ ধরার জেলে, ইলিশ মাছ ধরার জেলে, কাঁকড়া ধরার জেলে, চিংড়ি পোনা ধরার জেলে, টেংরা, ফাইস্যা প্রভৃতি মাছ ধরার জেলে। যে জেলে যে মাছ ধরে সে জেলে অন্য মাছ ধরে না। তারা এক ধরনের মাছ ধরতে ধরতে সেই মাছ ধরার কৌশল আয়ত্ব করে ফেলে। তারপর তারা জানে বনের কোথায় কোথায় তারা যে মাছ ধরে সে মাছ পাওয়া যায়। এক ধরনের মাছ সুন্দরবনের সক খালে পাওয়া যায় না। বিশেষ জায়গায় বিশেষ বিশেষ ধরনের মাছ পাওয়া যায়। সে মোতাবেক জেলেরা সেখানে গিয়ে মাছ ধরে।

মাছ ধরার বিভিন্ন পদ্ধতির উপর নির্ভর করে সুন্দরবনের জেলেদের বিভিন্ন নাম করণ করা হয়। যেমন আটন জেলে, দাড়িয়া জেলে, সাভার জেলে ইত্যাদি। সুন্দরবনে মাছ ধরার জন্য বিভিন্ন ধরনের জাল ও বরশি ব্যবহার করা হয়। পাশ করার সময় যে জাল বা বরশি দিয়ে মাছ ধরা হবে তার নাম পাশে পাশে লেখা থাকে। পাশে উল্লেখিত জালের নাম দেখেই বুঝা  যায় জেলের নিকট কোন ধরনের মাছ আছে। যে সব জাল দিয়ে সুন্দরবনে মাছ ধরা হয় সে গুলো হলো- ১) বরশী, ২) দড়ি বরশী, ৩) চরপাটা, ৪) দাড়ির জাল, ৫) বেড় জাল, ৬) ছান্দি জাল, ৭) বিন্দি জাল, ৮) আটন জাল, ৯) ঝাকি ঝাল, ১০) কোমর জাল, ১১) সাভার জাল, ১২) পাতা জাল বা নেট জাল, ১৩) টানা জাল (রকেট জাল)।
.
-চলবে

No comments:

Post a Comment

Follow Us @VisitSundaebon