Wednesday, April 25, 2018

সুন্দরবন: পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সম্পর্কে কিছু তথ্য - ০১

সুন্দরবন পৃথিবীর একক বৃহত্তম ও সম্মুদ্ধতম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। বাংলাদেশের দক্ষিন-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেষে গড়ে উঠেছে এই বিস্তীর্ন বন। দেশে সংরক্ষিত বনের শতকরা একান্ন ভাগই সুন্দরবন বনাঞ্চল। প্রায় দশ হাজার বর্গ কিলোমিটার জুডে বিস্তৃত সুন্দরবনের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা বাংলাদেশে অবস্থিত এবং এক-তৃতীয়াংশ এলাকা ভারতে অবস্থিত। সুন্দরবন অর্প্বু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সম্পদ এবং জীব বৈচিত্রে সমৃদ্ধশালী হওয়ায় ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এছাড়া বৈজ্ঞানিক, নৃতত্ব ও প্রত্মতাত্ত্বিক বিবেচনায় সুন্দরবন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কাঠ, মাছ, মধু, গোলপাতা এবং ঘর তৈরীর বিভিন্ন উপকরনের জন্য সুন্দরবনের উপর বর্তমানে প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় পয়ত্রিশ লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুন্দরবনের সম্পদের উপর নির্ভরশীল।

অসংখ্য নদী-নালা ও খাল জালের মত জড়িয়ে আছে এই বনের মধ্যে যা বন প্রকৃতির এক অপরূপ চিত্তাকর্ষক ও বিস্ময়কর অবদান। বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশ, ডাঙ্গায় বিশ্ববিখ্যাত হিংস্র রয়েল বেঙ্গল টাইগার, বন্য শুকোর, বানর, বিষাক্ত সাপ ও সরিসৃপ আর পানিতে কুমির এর ভয়কে তুচ্ছ করে স্থানীয় জেলে বাওয়ালী, মৌয়ালীসহ বহু পেশা জীবির লোকেরা তাদের জীবিকাক্ষ সন্ধানে সুন্দরবনে যায়। যান্ত্রিক ও এক ঘেয়েমি জীবনের ক্লান্তি অবসানে সজীব নিঃশ্বাস নিতে মানুষ খোজে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বৈচিত্র। সে দিক বিবেচনায় অসংখ্য প্রজাতির উদ্ভিদ ও পশু-পাখির এক স্বর্গ রাজ্য, চোখ জুড়ানো চিত্রা হরিণ, গাছে গাছে মৌমাছির চাক, বিভিন্ন শ্রেনীর মাছ, সাগর ও বনের সংমিশ্রনে এক অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য, বাওয়ালী, মৌয়ালী ও জেলে সম্প্রদায়ের গান বাজনা ও নানা প্রকার সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড উপভোগ করার জন্য সুন্দরবন পর্যটকের জন্য খ্বুই আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।

সুন্দরবন নামকরণ : সুন্দরবনের প্রধান উদ্ভিদ সুন্দরী গাছ। সম্ভবতঃ এই সুন্দরী গাছের নাম অনুসারে বনের নাম হয়েছে সুন্দরবন। আবার সমুদ্রের নিকটে অবস্থিত বিধায় সমুন্দর শব্দ হতে প্রথমে সমুন্দরবন ও পরে সুন্দরবন নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।

সুন্দরবনের পুর্ব কথা : আজ থেকে প্রায় দুইশত বছর পুর্বে অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সুন্দরবনের আয়তন বর্তমানের প্রায় দ্বিগুন ছিল এবং জমিদারদের নিয়ন্ত্রনাধীন ছিল। ১৮২৮ সালে বৃটিশ সরকার সর্বপ্রথম সুন্দরবনের স্বত্ত্বাধিকার অর্জন করে। ১৮৩০ সাল থেকে সুন্দরনের বিভিন্ন অংশ লীজ দেওয়া শুরু হয়। ইউরোপীয়ানরা এই লীজ গ্রহণ করে অমূল্য এ বনাঞ্চলকে পরিস্কার করে আবাদী জমিতে রূপান্তর করতে থাকে। ফলে সুন্দরবনের আয়তন ব্যাপক হারে কমতে থাকাক্ষ পর সরকারের বোধোদয় ঘটে এবং ১৮৭৮ সালে সুন্দরবনকে সংরক্ষিত বন হিসাবে ঘোষনা দেয়া হয় ও ১৮৭৯ সালে সুন্দরবনের দায়-দায়িত্ব বন বিভাগের উপর ন্যস্ত করা হয়। সর্বপ্রথম ১৮৩১ সালে বর্তমান খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলা জুড়ে সুন্দরবনের মানচিত্র প্রকাশিত হয়। সর্বশেষ ১৯৮৫ সালে আরও একটি মানচিত্র প্রকাশিত হয়।

সুন্দরবনের ভৌগলিক অবস্থা ও ভূ-প্রকৃতি : সুন্দরবন বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেষে পুর্বে বলেশ্বর ও পশ্চিমে হাড়িয়াভাঙ্গা নদের মধ্যবর্তী অংশে বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ-পশ্চিম কোনে অবস্থিত। এর মধ্যে তিনটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এলাকা রয়েছে। খুলনা,বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার দক্ষিনে বঙ্গোপসাগরের তীরে সমুদ্র পৃষ্ঠের গড় উচ্চতার চেয়ে সুন্দরবনের ভূমি ০.৯ মিটার হতে ২.১১ মিটার উচু। সমগ্র বন এলাকায় প্রতিদিন দুই বার করে জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়। অত্র অঞ্চলের পানির লবণাক্ততা ঋতুভেদে এবং পুর্ব পশ্চিমের অবস্থান ভেদে তারতম্য হয়। বর্ষাকালে লবনাক্ততা হ্রাস পায় এবং শীতকালে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায়। লবণাক্ততার মাত্রার উপর ভিত্তি করে সুন্দরবন-কে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে যথা-মিষ্টি/স্বাদু পানি এলাকা, মধ্যম লবনাক্ত পানি এলাকা এবং লবনাক্ত পানি এলাকা। সুন্দরবন সংরক্ষিত বনাঞ্চল বাংলাদেশ বন বিভাগের খুলনা অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণাধীন। এ অঞ্চলের আওতায় দু’টি বন বিভাগ রয়েছে, যা সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ ও সুন্দরবন পুর্ব বন বিভাগ নামে পরিচিত। দাকোপ,পাইকগাছা, কয়রা,শ্যামনগর উপজেলার ৩,৫৭,৩৪১ হেঃ এলাকা সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের আওতাধীন এবং দাকোপ, মংলা, মোড়লগঞ্জ, শরনখোলা উপজেলার ২,৪৩,১৪৭ হেঃ এলাকা সুন্দরবন পুর্ব বন বিভাগের আওতাধীন। উক্ত বন বিভাগ দু’টির সদর দফতর যথাক্রমে খুলনা ও বাগেরহাটে এবং রেঞ্জ সদর নলিয়ান,বুড়িগোয়ালিনী,চাঁদপাই, শরনখোলায় অবস্থিত। দু’টি বন বিভাগের অধীনে চারটি ফরেষ্ট রেঞ্জ রয়েছে যা শরণখোলা, চাঁদপাই,খুলনা ও সাতক্ষীরা। সতেরটি ষ্টেশন এবং বাহাত্তরটি টহল ফাঁড়ি/ক্যাম্প বিদ্যমান।সুন্দরবন ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনায় আটটি ওয়ার্কিং সার্কেল রয়েছে যা সুন্দরী ওয়ার্কিং সার্কেল, গেওয়া ওয়ার্কিং সার্কেল, জ্বালানী কাঠ ওয়ার্কিং সার্কেল, গোলপাতা ওয়ার্কিং সার্কেল, বন্য প্রাণী ও চিত্ত বিনোদন ওয়ার্কিং সার্কেল, জলজ সম্পদ ওয়ার্কিং সার্কেল, কেওড়া ওয়ার্কিং সার্কেল ও মিশ্র ওয়ার্কি সার্কেল নামে অভিহিত।

সুন্দরী ওয়ার্কিং সার্কেল : সুন্দরী গাছের আধিক্য সম্পন্ন বনাঞ্চল যথা শরনখোলা, চাঁদপাই ও খুলনা রেঞ্জ সমন্বয়ে এই সার্কেল গঠিত। আনুমানিক ব্যাপ্তি ২,৩১,১৫৯ হেঃ। উল্লেখ্য যে, সুন্দরীকাঠ আহরনে সুন্দরবনের প্রকৃত বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট প্রায় শতকরা পঞ্চাশ ভাগ। প্রতিবছর জেলেদের দ্বারা সুন্দরী খুটি কর্তন, নদীর ভাঙ্গন, অবৈধ চোরা কাঠ পাচারকারীদের দ্বারা সুন্দরী কাঠ অপসারণ ইত্যাদি বিষয় গুলির দিকে নজর রেখে আহরণ মাত্রা সীমিত রাখা হয়েছে। যাতে প্রতি বছর উল্লেখিত সুন্দরী কাঠ আহরনের ফলে বনের গ্রোয়িং ষ্টক কোন ভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ হতে না পারে। সুন্দরীর কাঠের সাথে মিশ্রিত কেওড়া ও অন্যান্য প্রজাতির কাঠের ক্ষেত্রেও একই বিধান প্রযোজ্য।

গেওয়া ওয়ার্কিং সার্কেল : গেওয়া গাছ সমৃদ্ধ ২,৯৬,৬৯৮ হেঃ বনাঞ্চল। এই ওয়ার্কিং সার্কেল শুধুমাত্র খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলে গেওয়া কাঠ সরবরাহের জন্য বিশেষভাবে চিহ্নিত ছিল। সুন্দরবন হতে বছরে ১৮ লক্ষ ঘনফুট গেওয়া কাঠ আহরণ করা সম্ভব। পরিকল্পিত পন্থায় নিয়মিত গেওয়া কাঠ আহরিত না হলে বনের উৎপাদন ক্ষমতা লোপ পাবার সম্ভাবনা রয়েছে। বন্য প্রাণী অভয়ারন্যকে এই সার্কেলের কর্মকান্ড বহির্ভুত রাখা হয়েছে।

জ্বালানী কাঠ ওয়ার্কিং সার্কেল : এই ওয়াকিং সার্কেলটি নৃতন ভাবে সংযোজন করা হয়েছে। বন্যপ্রানী অভয়ারন্য এলাকা এবং স্বল্প ষ্টক সম্মৃদ্ধ ১১টি কম্পার্টমেন্ট বাদে সুন্দরবনের অবশিষ্টাংশ এই সার্কেলের অন্তর্ভুক্ত। জ্বালানী আহরণযোগ্য এলাকার পরিমান ২,০২,২০৭ হেঃ। জ্বালানী কাঠ হিসাবে গড়ান প্রজাতির অবস্থান সর্বশীর্ষে এবং সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জে গড়ান কাঠের আধিক্য দেখা যায়। এলাকা ভিত্তিতে গড়ান আহরনের ব্যবস্থাপনায় বার্ষিক আহরণ মাত্রা ১০,১১০ হেঃ নির্ধারণ করা আছে। সুন্দরবণ পুর্ব বন বিভাগ হতে বছরে প্রায় ২ লক্ষ মন গড়ান জ্বালানী আহরণ করে বনের উৎপাদন ক্ষমতা সঠিক রাখা সম্ভব।

গোলপাতা ওয়ার্কিং সার্কেল : সমগ্র সুন্দরবনে বিস্তৃত গোলপাতা সমৃদ্ধ নদী ও খালের স্ট্রীপ সমন্বয়ে এ সার্কেল গঠিত। বিদ্যমান ষ্টক ও অতীত রেকর্ডের ভিত্তিতে বার্ষিক আহরণ মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ নির্ধারণ মাত্রা অনুযায়ী সুন্দরবন পুর্ব বন বিভাগ হতে গোলপাতা আহরনের লক্ষমাত্রা প্রায় ২৬,০০০ মেঃ টন। অভয়ারন্য সমুহ হতে গোলপাতা আহরনের জন্য ভিন্ন লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা আছে।

বন্য প্রাণী ও চিত্ত বিনোদন ওয়ার্কিং সার্কেল ঃ সুন্দরবনের বিদ্যমান ৩টি বন্য প্রাণী অভয়ারন্য সমন্বয়ে এ সার্কেল গঠিত। এই সার্কেলে বিশেষ প্রয়োজন ব্যতীত সকল প্রকান বনজ আহরণ নিষিদ্ধ আছে। অবশ্য অভয়ারন্যের বাহিরে চিত্ত বিনোদন ও বন্য প্রাণীর জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এলাকা সমুহ এ সার্কেলের অন্তর্ভুক্ত।

জলজ সম্পদ ওয়ার্কিং সার্কেল : বন্য প্রাণী অভয়ারন্য ছাড়া সুন্দরবনের অবশিষ্ট জলাভূমির সমন্বয়ে এ সার্কেল গঠিত। মাছ, কাকড়া, ঝিনুক ইত্যাদি আহরনের বিষয়ে কিছু বিধি নিষেধ এ সার্কেলের ব্যবস্থাপনায় সংযোজন করা আছে।

কেওড়া ওয়ার্কিং সার্কেল : কেওড়া প্রজাতির অধিকতর ঘনত্ব সম্পন্ন বনাঞ্চল সমন্বয়ে এ সার্কেল গঠিত। সুন্দরী ওয়ার্কিং সার্কেলের সাথে নদী ও খালের পাড় সংলগ্ন ও নুতন চরের একক কেওড়া প্রজাতির বনে এই সার্কেলের ব্যবস্থাপনা নির্দেশনা প্রযোজ্য। এই প্রজাতির আহরণ সর্বনিম্ন ১৫.০০ সেঃমিঃ নির্ধারণ করা আছে।

মিশ্র ওয়ার্কিং সার্কেল : অভয়ারন্য ব্যতীত সমগ্র সুন্দরবনের এলাকা জুড়ে এ সার্কেলের ব্যাপ্তি। এ সার্কেলের অথীনে বনের অন্যান্য অপ্রধান বনজ দ্রব্য যেমন মধু, মোম, হেতাল, মালিহা ঘাষ, সন, বলা জ্বালানী ইত্যাদি আহরনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সমগ্র সুন্দরবন হতে বছরে ১০০০ মেঃটন হেতাল, ৪৭০০ মেঃটন ঘাষ, ১৩০ টন মধু আহরনের লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারিত আছে। এ সার্কেলের অধীনে শুকনো মওসুমে দুবলা জেলে পল্লীতে জেলেদের অস্থায়ী ঘর নির্মানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

সুন্দরবনের জীব বৈচিত্র : উদ্ভিদকুল ঃ বিশ্বের অন্যান্য ম্যানগ্রোভ বনের তুলনায় সুন্দরবন জীব বৈচিত্রে অধিকতর সমৃদ্ধ। সুন্দরবনে ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল এবং ১৩ প্রজাতির অর্কিড পাওয়া যায়। এদের মধ্যে সুন্দরী, কেওড়া, বাইন, পশুর, কাঁকড়া, গরাণ গোলপাতা, সিংড়া, বলা, হেতাল, খলসী, গেওয়া ইত্যাদি প্রধান। সুন্দরবন সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সমস্ত গাছপালাই দেশীয়। কোন বিদেশী বা ভিন্ন অঞ্চলের গাছের কোন প্রজাতি এখানে নেই এবং এখানে সেগুলো উপযোগীও নয়। কিন্তু সুন্দরীর অনিয়ন্ত্রনযোগ্য আগামরা রোগের জন্য এই প্রজাতি এখন হুমকির সম্মুখীন।
.
-চলবে

No comments:

Post a Comment

Follow Us @VisitSundaebon