Wednesday, April 25, 2018

আমাদের সুন্দরবন ও এর সম্পর্কে কিছু জানা-অজানা তথ্য !

সুন্দরবন সমুদ্র উপকূলবর্তী পৃথিবীর সবচেয়ে বড়  ম্যানগ্রোভ  বনভূমি। এই বনভূমি গঙ্গা ও  ব্রহ্মপুত্র  মোহনায় অবস্থিত এবং বাংলাদেশ ও ভারতের  পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে বিস্তৃত। সুন্দরবন ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান  হিসেবে স্বীকৃতি পায়। সুন্দরবনের মোট আয়তন ১০০০০ বর্গ কি.মি। এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশের আয়তন প্রায় ৬,০১৭ বর্গ কি.মি। বনভূমিটি, বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও নানান ধরণের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। এছাড়া এই বনভূমিতে বিখ্যাত সুন্দরী ও গোলপাতা গাছও পাওয়া যায়। এই বনের মৌমাছিদের তৈরি মৌচাক থেকে প্রচুর মধু সংগ্রহ করা হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। এইসব সুন্দরবন সম্পর্কিত তথ্য আমরা সবাই-ই বাংলা ২য় পত্রের রচনায় কিংবা বাংলা ১ম পত্রের গদ্যে জেনে এসেছি। আমাদের মধ্যে অনেকেই এর চেয়ে বেশী তেমন কিছু জানি না অথচ আমাদের দেশের এই প্রাকৃতিক সম্পদ কিনা পৃথিবীর অন্যতম একটি সুন্দর জায়গা হিসেবে বিশ্ব-বিখ্যাত। তাই আজকে আমি সুন্দরবন সম্পর্কে কিছু মৌলিক ও আকর্ষণীয় তথ্য উপস্থাপন করার চেষ্টা করব।
আমাদের সুন্দরবন

নামকরণঃ

বাংলায় “সুন্দরবন”-এর আক্ষরিক অর্থ “সুন্দর জঙ্গল” বা “সুন্দর বনভূমি”। সুন্দরী গাছ  থেকে সুন্দরবনের নামকরণ হয়ে থাকতে পারে, যা সেখানে প্রচুর জন্মায়। অন্যান্য সম্ভাব্য ব্যাখ্যা এরকম হতে পারে যে, এর নামকরণ হয়তো হয়েছে  “সমুদ্র বন”(প্রাচীন আদিবাসী) থেকে। তবে  সাধারণভাবে ধরে নেয়া হয় যে  সুন্দরী গাছ থেকেই সুন্দরবনের নামকরণ হয়েছে।

ভৌগোলিক গঠনঃ

দুই প্রতিবেশি দেশ বাংলাদেশ এবং ভারত জুড়ে বিস্তৃত সুন্দরবনের বৃহত্তর অংশটি ( ৬২%) বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত। দক্ষিণে  বঙ্গোপসাগর; পূর্বে বালেশ্বর নদী আর উত্তরে বেশি চাষ ঘনত্বের জমি বরাবর সীমানা। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সুন্দরবনের আয়তন বর্তমানের প্রায় দ্বিগুণ ছিল। বনের উপর মানুষের অধিক চাপ ক্রমান্বয়ে এর আয়তন সংকুচিত করেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে এর মোট ভূমির আয়তন ৪,১৪৩ বর্গ কি.মি. এবং নদী ও খালসহ বাকি জলধারার আয়তন  ১,৮৭৪ বর্গ কি.মি. । সুন্দরবনের নদীগুলো নোনা পানি ও মিঠা পানি মিলন স্থান। সুতরাং গঙ্গা থেকে আসা নদীর মিঠা পানির, বঙ্গপোসাগরের নোনা পানি হয়ে ওঠার মধ্যবর্তী স্থান হলো এ এলাকাটি। এটি সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী অঞ্চল জুড়ে রয়েছে বাংলাদেশে।
ভাঁটার পর সুন্দরবনের কর্দমাক্ত মাটি
ভাঁটার পর সুন্দরবনের কর্দমাক্ত মাটি

উদ্ভিদের বিচিত্রতাঃ

সুন্দরবনের প্রধান বনজ বৈচিত্রের মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে সুন্দরী, গেওয়া, গরান এবং কেওড়া । ১৯০৩ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের হিসেব মতে সর্বমোট ২৪৫টি শ্রেণী এবং ৩৩৪টি প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে সেখানে।
গোলপাতা গাছ
গোলপাতা গাছ
এই প্রতিবেদনের পর সেখানে বিভিন্ন ম্যানগ্রোভ প্রজাতি ও তাদের শ্রেণীকরণের এর উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। বনজ প্রকৃতিতে খুব কমই অনুসন্ধান করা হয়েছে এসব পরিবর্তনের হিসেব রাখার  জন্য। ঘাস ও গুল্মের মধ্যে রয়েছে  শন, নল খাগড়া, গোলপাতা ইত্যাদি। কেওড়া নতুন তৈরি হওয়া পলিভূমিকে নির্দেশ করে এবং এই প্রজাতিটি বন্যপ্রাণীর জন্য জরুরী , বিশেষ করে চিত্রা হরিণের জন্য।

প্রাণীবৈচিত্র্যঃ

সুন্দরবনে ব্যাপক প্রাণীবৈচিত্র্য বিদ্যমান। প্রাণীবৈচিত্র্য সংরক্ষণ  ব্যবস্থাপনা সুন্দরবনের কিছু কিছু এলাকায় শিকার নিষিদ্ধ করেছে যার ফলে শর্তহীনভাবে বনজ সম্পদ সংগ্রহ করা যায় না এবং বন্য প্রাণীর জীবনে সামান্যই ব্যাঘাত ঘটে। যদিও এটা স্পষ্ট যে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের প্রাণী সম্পদ হ্রাস পেয়েছেএবং সুন্দরবনও এর বাইরে নয় । তারপরও সুন্দরবন বেশ অনেকগুলি প্রাণী  প্রাজাতি ও তাদের সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য প্রজাতিদের টিকিয়ে রেখেছে। এদের মধ্যে বাঘ  শুশুককে প্রাধান্য দিয়ে পরিকল্পনা করা হচ্ছে।   সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান মৌলিক প্রকৃতির এবং যা বন্য প্রাণীর বিশাল আবসস্থল।  কচ্ছপ, গিরগিটি, অজগর এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগার সুন্দরবনের স্থানীয় প্রজাতিগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিভিন্ন প্রজাতির  হরিণ, মহিষ, গন্ডার এবং কুমিরের  এর মত কিছু কিছু প্রজাতি সুন্দরবনে বিরল হয়ে উঠেছে ২১ শতকের শুরু থেকে।
চিত্রা হরিণ
চিত্রা হরিণ
বাংলাদেশের সুন্দরবন বাণিজ্যিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ১২০ প্রজাতির মাছ, ২৭০ প্রাজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ সরীসৃপ এবং ৮ টি উভচর প্রজাতির আবাসস্থল। এ থেকে বোঝা যায় যে বাংলাদেশের সুন্দরবনে বিভিন্ন প্রজাতির একটি বড় অংশ বিদ্যমান (যেমনঃ ৩০ শতাংশ সরীসৃপ, ৩৭শতাংশ পাখি ও ৩৭ শতাংশ স্তন্যপায়ী)। পাখি বিষয়ক পর্যবেক্ষণ, পাঠ ও গবেষণার ক্ষেত্রে পাখিবিজ্ঞানীদের জন্য সুন্দরবন এক স্বর্গ।
কুমির
কুমির
ঈগল পাখি
ঈগল পাখি

রয়েল বেঙ্গল টাইগারঃ

সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার নামক বাঘ বিশ্ব-বিখ্যাত। ২০০৪ সালের হিসেব মতে, সুন্দরবন প্রায় ৫০০ রয়েল বেঙ্গল টাইগার বাঘের আবাসস্থল যা বাঘের একক বৃহত্তম অংশ। কিন্তু এই বাঘের সংখ্যা দিনকে-দিন কমে আসছে। ২০১১ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমানে সুন্দরবনে মোট বাঘের সংখ্যা প্রায় ৩০০। এদের সংরক্ষণের জন্য বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কমিটি নানা ধরণের কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
এছাড়াও এসব বাঘ গড়ে প্রতি বছরে প্রায় ৩০ থেকে ১০০ জন মানুষ মেরে ফেলার কারণেও ব্যপকভাবে পরিচিত। তবে নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়ায় ভারতীয় অংশের সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে একটিও মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। স্থানীয় লোকজন ও সরকারীভাবে দ্বায়িত্বপ্রাপ্তরা বাঘের আক্রমণ ঠেকানোর  জন্য বিভিন্ন নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন। স্থানীয় জেলেরা বনদেবী বা  বনবিবির প্রার্থনা ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করে যাত্রা শুরুর আগে। সুন্দরবনে নিরাপদ বিচরণের জন্য বাঘের দেবতার  প্রার্থনা করাও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কাছে জরুরি। বাঘ যেহেতু সবসময় পেছন থেকে আক্রমণ করে  সেহেতু জেলে এবং কাঠুরেরা মাথার পেছনে মুখোশ পরে। এ ব্যবস্থা স্বল্প সময়ের  জন্য কাজ করলেও পরে বাঘ এ কৌশল বুঝে ফেলে এবং আবারও আক্রমণ হতে থাকে। সরকারি কর্মকর্তারা আমেরিকান ফুটবল খেলোয়াড়দের প্যাডের মত শক্ত প্যাড পরেন যা গলার পেছনের অংশ ঢেকে রাখে। এ ব্যবস্থা করা হয় শিরদাঁড়ায় বাঘের কামড় প্রতিরোধ করার জন্য যা তাদের পছন্দের আক্রমণ কৌশল।
রয়েল বেঙ্গল টাইগার
রয়েল বেঙ্গল টাইগার
এসব বাঘ কেন মানুষকে আক্রমণ করে তার কিছু অনুমিত কারণ এরকমঃ
  • যেহেতু সুন্দরবন সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় অবস্থিত সেহেতু তুলনামূলকভাবে এখানকার পানি নোনতা। এখানকার অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে বাঘই মিঠাপানি খায়। কেউ কেউ মনে করে পেয়পানির এই লবণাক্ততার কারণে বাঘ সার্বক্ষণ অস্বস্তিকর অবস্থায় থাকে যা তাদের ব্যপকভাবে আগ্রাসী করে তোলে। কৃত্রিম মিঠাপানির হ্রদ তৈরি করে দিয়েও এর কোনো সমাধান হয়নি।
  • উঁচু ঢেউয়ের কারণে বাঘের গায়ের গন্ধ মুছে যায় যা প্রকৃতপক্ষে বাঘের বিচরণ এলাকার সীমানা চিহ্ণ হিসেবে কাজ করে। ফলে নিজের এলাকা রক্ষায় বাঘের জন্য উপায় একটাই, আর তা হলো যা কিছু তাদের এলাকায় অনুপ্রবেশ করে তা বাঁধা দেয়া।
  • অন্য একটি সম্ভাবনা এমন যে আবহাওয়ার কারণে এরা মানুষের মাংসে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ও ভারতের এ অঞ্চলে জলোচ্ছ্বাসে হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। আর স্রোতের টানে ভেসে যাওয়া এসব গলিত মৃতদেহ বাঘ খায়।
  • আর একটি সম্ভাবনা হলো এরকম যে, নিয়মিত উঁচু-নিচু স্রোতের কারণে এবং পিচ্ছিল হয়ে ওঠা এলাকায় বাঘের পশু শিকার করার কঠিন হয়ে যায়। সেই তুলনায় সুন্দরবন জুড়ে মাছ ও মধু সংগ্রহকারী মানুষ শিকার করা সহজ হয়ে ওঠে বলে এরা মানুষকে শিকার বানাতে পছন্দ করে। এরকমও বিশ্বাস করা হয় যে মানুষ যখন কাজ বন্ধ করে বসে থাকে তখন বাঘ তাকে পশু ভেবে আক্রমণ করে।
  • এছাড়াও মনে করা হয় যে আবাসস্থলের বিচ্ছিন্নতার কারণে এই অঞ্চলের বাঘ তাদের শিকারকরার বৈশিষ্ট্য বদলে ফেলেছে যা ২০ শতক জুড়ে ঘটেছে। এশিয়ার বাকি অংশে বাঘের মানুষভীতি বাড়লেও সুন্দরবনের বাঘ মানুষকে শিকার বানানো বন্ধ করবে না হয়তো।

মৎস্য সম্পদঃ

সুন্দরবনের সামগ্রিক মাছের ওপর পূর্বাপর কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়নি। ফলে মাছের বর্তমান অবস্থা, বিলুপ্ত মাছ, বিলুপ্তপ্রায় মাছের ওপর উপাত্তনির্ভর তথ্য পাওয়া যায় না। শুধু, মানুষ যেসব মাছ খায় এবং যেসব মাছ রপ্তানি উপযোগী, সেসব মাছ চিহ্নিত করা হয়েছে। ধারণা করা হয়, সুন্দরবনে শিরদাঁড়াওয়ালা মাছ রয়েছে প্রায় ৩০০ প্রজাতির। সুন্দরবনে মৎস্যসম্পদকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। সব মাছ মিলিয়ে হয় সাদা মাছ, বাকিরা বাগদা, গলদা, কাঁকড়া।
আশির দশকে চিংড়ির পোনা ধরা শুরু হওয়ার পর মাছের প্রাচুর্য হঠাৎ কমে যায়। একসময় স্থানীয় জনসাধারণের প্রাণিজ প্রোটিন ৮০ শতাংশ মেটাতো মাছ। এখন মাছ খাওয়ার সৌভাগ্য এলাকার খুব কম লোকের ভাগ্যে জোটে। সুন্দরবনে কালা হাঙর, ইলশা কামট, ঠুঁটি কামট, কানুয়া কামট পাওয়া যায়। আগে এদের খালিশপুর এলাকা পর্যন্ত পাওয়া যেতো, এখন অনেক দক্ষিণে সরে গেছে। পশ্চিম সুন্দরবনে এদের উৎপাত বেশি। এরা সংখ্যায় অনেক কমে গেছে, বিশেষ করে কালা হাঙর প্রায় দেখাই যায় না।

হাঙ্গর মাছ
হাঙ্গর মাছ
একসময় জাভা মাছের খুব নাম শোনা যেতো, এরা ৫৫ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। এখন দেখা পাওয়া ভার। পায়রাতলী বা চিত্রার মতো অত্যন্ত সুস্বাদু মাছ আজকাল জেলেদের জালে খুব কম পড়ছে।সুন্দরবনের সবচেয়ে পরিচিত মাছ পারশে মাছ। ১৬ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা এ মাছটি জঙ্গলের সর্বত্র প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেতো। এখনো পাওয়া যায় খুব কম। পারশেরই জাতভাই বাটা ভাঙান। ভাঙান, গুল বাটা, খরুল ভাঙান আজকাল খুব কম ধরা পড়ে। খরশুলা বা খল্লা অত্যন্ত সুস্বাদু মাছ; বনের নদী-খালে এদের তেমন আর দেখতে পাওয়া যায় না।মারাত্মক মাছ কান মাগুর-এর পাশের কাঁটায় মারাত্মক বিষ রয়েছে। বড় কান মাগুর এখনো কিছু পাওয়া গেলেও দাগি কান মাগুর এখন বিলুপ্তপ্রায়। এছাড়াও আরও অনেক ধরনের মাছ আছে যাদের মধ্যে অধিকাংশই বিলুপ্তপ্রায় অবস্থায়
সুন্দরবনে বর্তমানে ১৩ ধরনের পদ্ধতিতে মাছ ধরা হয়। ঠেলা জাল, রকেট জালের ছিদ্র খুব ছোট হওয়ায় চারা মাছ এবং মাছের ডিম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুন্দরবন এলাকায় জেলে বাড়ায় মৎস্যসম্পদ দ্রুত কমে যাচ্ছে। তবে বিষ প্রয়োগে মাছ মারায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়। এখানকার স্থানীয়দের অধিকাংশই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে।
সুন্দরবনে মাছ ধরার নৌকা
সুন্দরবনে মাছ ধরার নৌকা

অর্থনীতিঃ

সুন্দরবনের জনসংখ্যা ৪০ লক্ষের বেশি। কিন্তু এর বেশির ভাগই স্থায়ী জনসংখ্যা নয়। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতিতে যেমন, ঠিক তেমনি জাতীয় অর্থনীতিতেও সুন্দরবনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এটি দেশের বনজ সম্পদের একক বৃহত্তম উৎস। এই বন কাঠের উপর নির্ভরশীল শিল্পে কাঁচামাল জোগান দেয়।
এ বন থেকে নিয়মিত ব্যাপকভাবে আহরণ করা হয় ঘর ছাওয়ার পাতা, মধু, মৌচাকের মোম, মাছ, কাঁকড়া এবং শামুক-ঝিনুক। বৃক্ষপূর্ণ সুন্দরবনের এই ভূমি একই সাথে প্রয়োজনীয় আবাসস্থল, পুষ্টি উৎপাদক, পানি বিশুদ্ধকারক, পলি সঞ্চয়কারী, ঝড় প্রতিরোধক, উপকূল স্থিতিকারী, শক্তি সম্পদের আধার এবং পর্যটন কেন্দ্র।
সুন্দরী গাছ
সুন্দরী গাছ
এই বন প্রচুর প্রতিরোধমূলক ও উৎপাদনমূলক ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৫১ শতাংশ জুড়ে সুন্দরবনের, বন থেকে আসা মোট আয়ে অবদান প্রায় ৪১ শতাংশ এবং কাঠ ও জ্বালানী উৎপাদনে অবদান প্রায় ৪৫ শতাংশ (বিশ্ব খাদ্য সংস্থা, ১৯৯৫)। অনেকগুলি শিল্প (যেমনঃ নিউজপ্রিন্ট, দেয়াশলাই, হার্ডবোর্ড, নৌকা, আসবাবপত্র) সুন্দরবন থেকে আহরিত কাঁচামালের উপর নির্ভরশীল। বিভিন্ন অ-কাঠজাত সম্পদ এবং বনায়ণ কমপক্ষে তিন লক্ষ উপকূলবর্তী জনসংখ্যার জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কর্মসংস্থান ও আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। উৎপাদনমূখী ভূমিকার পাশাপাশি সুন্দরবন, ঘূর্ণিঝড়প্রবণ বাংলাদেশের উপকূলবর্তী জনসংখ্যা ও তাদের সম্পদের প্রাকৃতিক নিরাপত্তাবলয় হিসেবে ভূমিকা রাখে।
ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর সুন্দরবনের একাংশ
ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর সুন্দরবনের একাংশ
বোঝাই যাচ্ছে যে, সৌন্দর্য, বনজ সম্পদ, কর্মসংস্থান, প্রাণী ও উদ্ভিদ বিচিত্রতা, মৎস্য সম্পদ, বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল জোগান, প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখা, বিভিন্ন প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে রক্ষা করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সুন্দরবনের ভূমিকা বলে শেষ করার মত না। আমাদের ও আমাদের দেশের উন্নয়নের জন্য এ দেশের মানুষের উচিত সুন্দরবনের বনজ সম্পদ ও বন্য-প্রাণীদের সংরক্ষণের প্রতি আরও মনোযোগ দেয়া। যেভাবে এর নানা ধরনের বনজ সম্পদ ও এতে বসবাস করা নানা প্রজাতির পশু, পাখি, মাছেরা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে তা আমাদের দেশের জন্য মারাত্মক হুমকি-স্বরূপ ও লজ্জাজনক একটি বিষয়।
পুরো পৃথিবীতেই আমাদের এই বনের চর্চা রয়েছে, প্রতি বছর সুন্দরবন দেখতে বাইরের দেশ থেকে হাজার হাজার লোক আসে, আর আমরা কিনা আমাদের এই অমূল্য সম্পদটিকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে রাখতে পারছি না। বিশেষ করে আমাদের দেশের সরকারের উচিত যে বনজ সম্পদ ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন আরও জোরদার ও কঠোর করা। আর আমরা যারা সুন্দরবনে ঘুরতে যাই তাদেরও সতর্ক থাকা উচিত যে আমরা যেন মজার ছলে বা হেলা-ফেলা করে এর বনজ সম্পদ ও বন্য প্রাণীর জীবনের কোনো ক্ষতি না করি; অন্যদেরকেও এই বিষয়ে সতর্ক করতে পারি কারণ প্রতি বছর এই কারণেই অনেক পশু-পাখি মারা যায়।

No comments:

Post a Comment

Follow Us @VisitSundaebon