Sunday, April 29, 2018

সুন্দরবনঃ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সম্পর্কে কিছু তথ্য - ১৫

সুন্দরবনের নদী নালাঃ সুন্দরবন অসংখ্য ছোট ছোট নদী নালা দ্বারা বেষ্টিত। এসব নদী,খাল ও ভারানী দ্বারা সুন্দরবনের কম্পার্টমেন্টগুলোকে একটি থেকে আরেকটিকে আলাদা করা হয়েছে। যখন একটি ছোট খাল দু’ টি নদীকে যুক্ত করে তাকে ভারানী বলে। সুন্দরবনে প্রবেশ করলে মনে হয় সুন্দরবনে শুধু পানি আর পানি। যত দক্ষিণ দিকে যাওয়া যায় ততই নদীর প্রস্থতা ও ভয়ংকরতা বাড়তে থাকে। সমগ্র সুন্দরবনের ৩০ ভাগ পানি। সুন্দরবনের মোট জল ভাগের পরিমান ১৭৫৬ বর্গ কিঃ মিঃ। বর্ষার সময় সুন্দরবনের কোন কোন বড় নদী ভয়ংকর হয়। এত বড় ঢেউ হয় তাতে যেমন তেমন লঞ্চ এসব নদী দিয়ে চলাচল করতে পারে না। সুন্দরবনের বিখ্যাত ও ভয়ংকর নদীর মধ্যে পশুর, শিবচা, আরপাংগাশিয়া, খোলপেটুয়া, মর্যাদ, যমুনা, মালঞ্চ ও বলেশ্বর উল্লেখযোগ্য। পশুর, মর্যাদ, বলেশ্বর, মালঞ্চ ও রাইমংগল নদী সমুদ্র মোহনায় প্রায় ৮-১০ কিঃ মিঃ প্রস্থ। এপার থেকে ওপার দেখা যায় না। বর্ষাকালে এসব নদী লঞ্চ, ট্রলার ও স্পীড বোট দিয়ে পাড়ি দেওয়া দুস্করঅ এক একটা ঢেউ পাহাড়ের মত মনে হয়। সুন্দরবনে আরো উল্লেখযোগ্য নদীর মধ্যে রয়েছে শেলা, মিরগামারী, ভোলা, সুপতি, বেতমোড়, হংসরাজ, ভদ্রা, বল, পাথরিয়া প্রভৃতি। এসব নদীতে কুমির বাস করে। তাছাড়া এসব নদী মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ি মাছ, চিংড়ি মাছের পোনা প্রভৃতি মৎস্য সম্পদে ভরপুর। মোট নদ নদীর সংখ্যা এক হাজারের ও বেশী হবে।

জোয়ার ভাটাঃ জোয়ার ভাটা সুন্দরবনের একটা বৈশিষ্ট। বৃক্ষরাজির জীবনধারণ, পশু পাখির চলাফেরা, জেলে, মৌয়ালী ও বাওয়ালীদের কর্মতৎপরতা ও বন ব্যবস্থাপনা অনেকাংশে জোয়ার ভাটার উপর নির্ভরশীল। সুন্দরবনে প্রতিদিন দু’ বার জোয়ার হয় এবং দু’ বার ভাটা হয়। জোয়ারের সময় সমুদ্রের লোনাপানি সুন্দরবনের ভিতরে প্রবেশ করে বনাঞ্চল প্লাবিত করে। নদী নালা পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। পানির সাথে সমুদ্র হতে সে সময় বিভিন্ন মাছ সুন্দরবনে নদ নদীতে আসে। ইলিশের মৌসুমে জোয়ারের সময় প্রচুর ইলিশ সুন্দরবনে প্রবেশ করে। জানুয়ারী হতে এপ্রিল মাসে জোয়ারের পানির সাথে ভেসে আসে কোটি কোটি চিংড়ি পোনা। জেলেদের জালপাতার হুড়াহুড়ি দেখলে মনে হয় এখনই জোয়ার হবে। যখন জেলেরা জাল গুটিয়ে ফেলতে শুরু করে তখন বুঝা যায় ভাটা হয়েছে। যখন ভাটা হয় তখন জেলেরা বিশ্রাম নেয় এবং জোয়ার এলে মাছ ধরার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। তেমনি ভ্রমনকারী, বনকর্মী ও মৎস্য পরিবহনকারীগন জোয়ার ভাটার সময় হিসেব করে চলাফেরা করে। অনেক সময় এ কারনে যাত্রা বিলম্ব হয়। যে দিকে পানির স্রোত যায় সেদিকে চললে সময় কম লাগে এবং অর্থ সাশ্রয় হয়। সাধারণত জোয়ারের সময় জোয়ারের দিকে এবং ভাটার সময় ভাটার দিকে অনুসরণ করে লঞ্চ চলাচল করে। নদ নদীর ঢেউয়ের প্রবনতা জোয়ার ভাটার উপর নির্ভরশীল। গ্রীষ্মকালে বাতাস দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়। সে সময় যথন ভাটা হয় তখন নদীতে বেশী ঢেউ হয়। কারণ গ্রীষ্মকালে ভাটার সময় পানি যায় দক্ষিণ দিকে আর বাতাস প্রবাহিত হয় উত্তর দিকে। তখন পানির স্রোত বাতাসে বাধাগ্রস্থ হয়ে ঢেউয়ের সৃষ্টি করে। শীতকালে বাতাস উত্তর দিক হদেক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়। সে সময় জোয়ারের সময় নদীতে ঢেউ বেশী হয়। সে জন্য নাবিকরা বর্ষাকালে যখন জোয়ার থাকে তখন সুন্দরবনের ভয়ংকর নদীগুলো পাড়ি দেয়। কারণ এসময় পানি ও বাতাস একই দিকে প্রবাহিত হয়। ফলে ঢেউ কম থাকে। পুর্নিমা অমাবস্যার জোয়ারের সময় বেশি পানি সুন্দরবনে প্রবেশ করে এবং সে সময় বেশী মাছ পাওয়া যায়। একবার জোয়ার ভাটা হতে সময় লাগে ১২ ঘন্টা ২৫ মিনিট। সমুদ্র হতে সুন্দরবনের উত্তর অংশ পর্যন্ত জোয়ার হতে সময় লাগে ২ ঘন্টা ৫ মিনিট। বলেশ্বর, শিবসা, পশুর, রাইমংগল, যমুনা ও মালঞ্চ নদীর মোহনা দিয়ে প্রধানত সমুদ্রের পানি সুন্দরবনে প্রবেশ করে। তারপর অন্যান্য নদী, খাল ও ভারানী দিয়ে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে বিস্তৃতি লাভ করে। জোয়ারের সময় সুন্দরবনের পানি স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে ৩ মিটার উচ্চতা বাড়ে। হিরণ পয়েন্টে পূর্ণ জোয়ার ও নলিয়ানে পূর্ণ জোয়ারের পার্থক্য হল ২.৫০ ঘন্টা। বিভিন্ন নদীর ম্হোনা দিয়ে সমুদ্র হতে সুন্দরবনে বিভিন্ন অংশে পানি প্রবেশের উপর ভিত্তি করে সুন্দরবনে নদীগুলোকে তিনটি সিরিজে ভাগ করা হয়েছে। যথা- (১) রাইমংগল, শিবসা সিরিজ, (২) পশুর ু শিবসা সিরিজ ও (৩) পশুর- বলেশ্বর সিরিজ।

রাইমংগল- শিবসা সিরিজঃ এ সিরিজে প্রধান প্রধান নদী ও খালের নাম হল রাইমংগল, যমুনা, মালঞ্চ, ফিরিগিং, আরপাংগাশিয়া, আড়াইবেকী, শিবসা, সোনাখাল, তালদ্বীপ ও কোবাদক। রাইমংগল নদী ভারত হতে বাংলাদেশে কৈখালীর নিকট যমুনাতে মিশেছে।

পশুর- শিবসা সিরিজঃ এ সিরিজের অন্যতম নদী ও খাল হলো পশুর, শিবসা, মরা ভদ্রা, মানকি ও ভদ্রা নদী।

পশুর- বলেশ্বর সিরিজঃ এ সিরিজে উল্লেখযোগ্য নদী ও খাল হল পশুর, বলেশ্বর, বড় শিয়ালা, মিরগামারী, শেলা, ভোলা, সুপতি, পাথরিয়া, বেতমোর ইত্যাদি। জোয়ার ভাটা সুন্দরবন পরিদর্শন ও কাজ কর্মে মুখ্য ভৃমিকা পালন করে। জোয়ারের সময় নৌকা, লঞ্চ, স্পীড বোট ও ট্রলার হতে বনে উঠা-নামা করতে সুবিধা বেশী। বনের কাঠ, লাকড়ী, নৌকায় ভর্তি করতে সুবিধা বেশি। এ সময় নদী বা খালের পানি বনের মেঝের কাছাকাছি থাকে। ফলে নৌযান বনের পাড়ে ভিড়ানো যায়। ভাটা হলে পানি নদী খালের তলায় এসে যায়। ফলে বনের পাড়ে নৌকা ভিড়ানো কষ্টকর। তখন বনে উঠতে গেলে এক হাটু কাঁদা পানি দিয়ে বনে ঢুকতে হয়। এমন কি অনেক সময় কোমর পর্যন্ত কাদা হয়। ভাটার সময় ছোট ছোট খাল শুকিয়ে যায়। তখন ইচ্ছা করলে গহীন বনে প্রবেশ করা যায় না।

সুন্দরবনের পশুর নদীঃ বিখ্যাত যে সব নদী সুন্দরবন সংরক্ষন ও ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভৃমিক্ ারাখে পশুর নদী তাদের মধ্যে অন্যতম। পশুর সুন্দরবনের একটি অন্যতম বৃহত্তম নদী। বাংলাদেশের দ্বিতীয় সামুদ্রিক বন্দর “ মংলা ” পশুর নদীর তীরে অবস্থিতঅ পশুর বর্ষাকালে বেশ ভয়ংকর ধারণ করে। সে সময় ছোট ঝোট লঞ্চ পশুর নদী পাড়ি দিয়ে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে যাওয়া বেশ মুশকিল। ফকিরহাট থানার বিলাঞ্চল হতে পশুরের জন্ম।এরপর চালনা বাজারের নিকট পশুর নদী রুপসা এবং পানখালীর সাথে মিশে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়। মংলা বন্দরের নিকট এসে মংলা নদীর সাথে মিলিত হয়ে সুন্দরবনের ঢাংমারী ফরেষ্ট ষ্টেশনের পাশ দিয়ে সোজা দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হতে থাকে। তখন পশুরের পশ্চিম পাড়ে সুন্দরবন এবং পুর্বপাড়ে কৃষি জমি ও জনপদ থাকে। এ ভাবে চলতে চলতে চাঁদপাই রেঞ্জের নন্দবালার নিকট হতে পশুর গভীর সুন্দরবনে প্রবেশ করে। তখন এর দু’ পাড়েই সুন্দরবন এভাবে চলতে তিন কোনা আইল্যান্ডের পশ্চিমে শিবসা সাথে মিলিত হয়ে মর্যাদ বা কোংগা নামে সমুদ্রে পড়ে। পশুরের আরেকটি ধারা দুবলার পুর্বদিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রে পড়েছে। একে মরা পশুরও বলে। এখানে উল্লেখ্য যে, পুর্বে ভৈরব ও পশুর নদীর সাথে কোন সংযোগ ছিল না। নড়াইল জেলার ধোন্দা গ্রামের রূপচাঁদ সাহা লবনের নৌকা যাতায়াতের জন্য ভৈরব নদী ও কাজিবাছা নদীকে সংযোগ করার জন্য একটি চিকন খাল কেটে দেন যা বর্তমানে রূপসা নদী নামে পরিচিত। প্রথমে এ খাল লাফ দিয়ে পার হওয়া যেত। পরবর্তীতে বাঁশের সাঁকোতে লোক জন পার হত। বর্তমানে রূপসা একটি গভীর, প্রশস্থ ও ভয়ংকর নদী। রূপচাঁদ সাহা ন্মা অনুসারে নদীর নাম হয় রূপসা।

No comments:

Post a Comment

Follow Us @VisitSundaebon