Monday, April 30, 2018

জীববৈচিত্রে সমৃদ্ধ বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের পাশেই যেন আরেক সুন্দরবন! প্রকৃতির নিয়মে সেটিকে আরো সুশোভিত করে তুলছে প্রাণিকুল। আসল সুন্দরবন ছেড়ে  সেখানে গিয়ে যেন আত্মীয় বাড়ি বেড়ানোর সুখ উপভোগ করছে তারা। সুন্দরবনের আকার বৃদ্ধি হয়ে হিরণ পয়েন্ট ও দুবলার চরের মাঝখানে জেগে ওঠা এই অঞ্চলটি সবার কাছে পরিচিতি পেয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু চর’ নামে।শুরুতে ফাঁকা থাকলেও এখন চরে অনেক গাছ-গাছালি জন্মেছে। সুন্দরবন থেকে হরিণ, শূকর, বানর ছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির সাপ সেখানে আবাস গেড়েছে।
জানা গেছে, প্রায় দুই যুগ আগে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে গিয়ে নতুন জেগে ওঠা চরের দেখা পান মৎস্যজীবী মালেক ফরাজি। ফিরে এসে তিনিই জনমানবহীন দ্বীপের নাম রাখেন ‘বঙ্গবন্ধু চর’।এরপর ১৯৯২ সালে অন্যান্য জেলেরাও দ্বীপটিতে যান। তখন এর আয়তন ছিল মাত্র দুই একর, বালি আর কাদায় ভরা। ২০০৪ সালের পর থেকেই দ্বীপটি বড় হতে থাকে। চলতি বছর দ্বীপটির আয়তন দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৮৪ বর্গকিলোমিটার।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের হিরণ পয়েন্ট থেকে ১৫ কিলোমিটার এবং দুবলারচর থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ‘বঙ্গবন্ধু চরের’ অবস্থান। চরটি সুন্দরবনের বন্যপ্রাণিদের অভয়ারণ্য (দক্ষিণ) এবং ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের মধ্যে পড়েছে। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু চরে কেওড়া, বাইন, সুন্দরি ও গরান প্রজাতির ম্যানগ্রোভ বৃক্ষ এবং লতাগুল্ম জন্মেছে।চরটি আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বন্যপ্রাণির অভয়াশ্রম এলাকা নীলকমলের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যাবে। বর্তমানে ভাটার সময় ওই দুই এলাকার মধ্যে ব্যবধান হয়ে রয়েছে ছোট্ট একটি খাল।
বঙ্গবন্ধু দ্বীপের বিষয়ে মোংলার চিলা ইউনিয়নের জেলে সরদার এবং দুবলার চরের মৎস্য ব্যবসায়ী মো. বেলায়েত হোসেন (৩৬) জানান, বর্তমানে চরটি হিরণ পয়েন্টের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। এজন্য ভাটা এলে সুন্দরবনের অনেক প্রাণি সাঁতার কেটে ওই চরে পাড়ি জমাচ্ছে। প্রায় ২০ বছর ধরে বেলায়েত সুন্দরবন এলাকায় ব্যবসা করছেন। বছরে ৪/৫ বার তার চরে যাওয়া পড়ে।বেলায়েতের ভাষায়, চরটি যেন সুন্দরবনের ভেতরে আরেক সুবিশাল সুন্দরবন, দেখতে ছবির মতো।
এ বিষয়ে সুন্দরবন খুলনা রেঞ্জের সিএফ আমির হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু চরে দিনকে দিন ইকো-ট্যুরিস্টদের পদচারণা বাড়ছে। তবে সেখানে কোনো পর্যটন স্পট করার পরিকল্পনা আপাতত বনবিভাগের নেই। চরটির পাশেই বিশ্ব ঐতিহ্য নীলকমল অভয়ারণ্য। এটি ন্যাচারাল ফরেস্ট, তাই এটিকে সংরক্ষণ করাই আমাদের কাজ।’ তবে আশঙ্কার বিষয় হলো, ২০১৫ সালে কোস্টগার্ড দ্বীপটির নাম ‘সরোয়ার স্যান্ড দ্বীপ’ উল্লেখ করে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার স্থাপনের অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসনে চিঠি দিয়েছে।এতে বলা হয়েছে, বঙ্গোপসাগরে চলাচলকারী নৌযান ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লাবাহী জাহাজের নিরাপত্তা দিতে পর্যবেক্ষণ টাওয়ারটি বসানো প্রয়োজন।এছাড়া চরের জমি চেয়ে ভূমি এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও পৃথক আবেদন করেছে কোস্টগার্ড। বঙ্গবন্ধু চরে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার বসালে সেটি জীববৈচিত্রের ওপর সরাসরি প্রভাব পড়বে।
তবে মোংলা কোস্টগার্ডের অপারেশন কর্মকর্তা লে. কমান্ডার ফরিদুজ্জামান বলেন, ‘টাওয়ারটি নির্মাণ হলে মোংলা ও পায়রা বন্দরে দেশি-বিদেশি জাহাজের নিরাপত্তা মনিটরিং করা সহজ হবে।’জেলেরা দুই যুগ আগে দ্বীপটি খুঁজে পেলেও ১৯৭৬ সাল থেকেই স্যাটেলাইট ইমেজে এর অস্তিত্ব ধরে পড়ে। এরপর দ্বীপটি মাঝেমধ্যে জেগে ওঠে, আবার ডুবে যায়। তবে ২০০৪ সাল থেকে দ্বীপের আকার ধীরে ধীরে স্থিতিশীল অবস্থায় আসতে থাকে। এখন  ক্রমেই বড় হচ্ছে এটি।চলতি বছরের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৯ সদস্যের গবেষক দল বঙ্গবন্ধু চরে গিয়ে তিন দিন অবস্থান করে। এ সময় তারা দ্বীপের অভ্যন্তরীণ মৃত্তিকা, ডিসিপি জরিপ ও ভিজিবিলিটি অ্যানালাইসিসসহ বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞানভিত্তিক অনুসন্ধান চালান।
প্রতিনিধি দলের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘জেগে উঠার পর থেকে কয়েক গুন বৃদ্ধি পেয়েছে বঙ্গবন্ধু দ্বীপের আয়তন। গেল এক যুগে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে।আমরা প্রায় ১৪ মিটার গভীর একটি ড্রিল করে এর অভ্যন্তরীণ মৃত্তিকা সংগ্রহ করেছি। তাতে দেখা গেছে, সমুদ্র তলদেশ থেকে চারটি পর্যায়ে দ্বীপটি গঠিত হয়েছে। বর্তমানে তা ধীরে ধীরে পূর্ণতা লাভ করছে।’ বাগেরহাটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘দ্বীপটি দেশের স্বার্থে কীভাবে ব্যবহার করা যায়, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’

সুন্দরবন হবে আরো সুন্দর!
সুন্দরবন নিয়ে বিস্তর কথা হচ্ছে, লেখালেখি হচ্ছে। সেটা দীর্ঘদিন ধরেই। সুন্দরবনের পাশে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে সবারই সুন্দর সুন্দর কথা বলার কথা ছিল। কিন্তু সবাই সুন্দরবন নিয়ে বেশি বেশি অসুন্দর কথা বলছেন। এটা মোটেও ঠিক নয়।
এক্ষেত্রে একমাত্র দায়িত্ব নিয়ে সুন্দর সুন্দর কথা বলার কাজটি করে চলেছে সরকার ও তার দায়িত্বশীল মন্ত্রণালয়। শুধু তাই নয়, সুন্দরবনকে সুন্দর করার যতো আয়োজন বর্তমান সরকারই সেটা নিজ দায়িত্বেই করে চলেছে। দেশের গণমাধ্যমও ‘সুন্দরবন ধ্বংস! সুন্দরবন ধ্বংস’ এসব না বলে চুপ থেকে চরম দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিচ্ছে।
সারাদেশের মতো সুন্দরবনেও বিদ্যুৎ সরবরাহ সময়ের দাবি। শুধু মানুষই বিদ্যুতের আলোয় থাকবে, এটা ঠিক নয়। বনের পশুপাখিরও আছে বন আলোকিত করে রাতের আঁধার কাটানোর অধিকার। এটা একটা যুক্তি। আবার অনেকে বলছেন, মাত্র ৯-১০ কিলোমিটার দূরত্বের রামপালে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র খুব বেশি কাছে হয়ে যায়। এটা বনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এটা প্রতিবেশ ঝুঁকিতে ফেলবে বন ও তার জীবজন্তু ও প্রাণীদেরকে। এক পর্যায়ে খাদ্যশৃঙ্খল নষ্ট হয়ে বন ও তার বাসিন্দারা ধ্বংস হয়ে যাবে।
বলি, একটি দেশের জন্য বনজঙ্গলের দরকারটাইবা কি? বনজঙ্গলে কি হয়? আমরা প্রাচীন ইতিহাসে পড়েছি, মানুষ উল্টো বনজঙ্গল কেটে মানব বসতি গড়ে সভ্যতা বিনির্মান করেছে। সুন্দরবনে মানববসতি গড়ে তোলা সময়ের দাবি। কয়েকদিন আগেই ঘোষণা হলো, দেশের জনসংখ্যা এখন নাকি ষোলো কোটি হয়েছে। এই ষোলো কোটি মানুষের দেশে বন উজাড় করে বসতি গড়ার দরকার আছে। এতো মানুষের জন্য আবাসন একটা বড় সমস্যা।
সুন্দরবন সাফ করে এর প্রক্রিয়া শুরু করা যেতে পারে। এ জন্য বনের বাসিন্দাদের উচ্ছেদ প্রয়োজন। কিন্তু হুটহাট করে বনের বাঘ, মোষ, সাপ, ব্যাঙ, কুমির, গুইসাপ, হরিণদেরকে উচ্ছেদ করলে বড়ই অমানবিক দেখায় বিষয়টা। আপনারা দেখেছেন, শহরের বস্তি উচ্ছেদ করলে তার বাসিন্দাদের কি দুর্দশাটাই না হয়। এক্ষেত্রে সুন্দরবনের ব্যাপারে দুর্দান্ত দূরদর্শী এক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র হলো সেই আধুনিক পদ্ধতি। এর বাসিন্দারা বসতিচ্যূত হবেন আগামি ৪০ বা ৫০ বছরে ধীরে ধীরে। সুন্দর এক উচ্ছেদ ব্যবস্থা।   
সরকারের পরিবেশ সমীক্ষা অনুযায়ী, রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলে প্রতিদিন ১৪২ টন বিষাক্ত সালফার ডাই অক্সাইড, ৮৫ টন বিষাক্ত নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড নির্গত হবে। বছরে ৯ লাখ টন অত্যন্ত ক্ষতিকর বিষাক্ত ছাই বাতাসে মিশবে। কয়লাবিদ্যুৎ প্লান্টের জন্য রামপালের পাশের পশুর নদী থেকে পানি তুলতে হবে, গরম পানি ফেলতে হবে।
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। এভাবেই নদীর পানি, জলজ জীববৈচিত্র্যের গোষ্ঠি নিপাত হবে। এভাবেই ওই এলাকা মানুষের বসবাসের উপযোগি করা হবে।
বিদ্যুতও পেলাম, সুন্দরবন থেকে ক্ষতিকর ও ভয়ানক সব জীবজন্তুর হাত থেকে মানবজাতি বিশেষ করে উপকূলীয় লোকজনকেও রক্ষা করলাম, এরকম একটা সুন্দর প্রকল্পের বিরোধিতা করা শুধু দেশদ্রোহীতাই নয়, রীতিমত মীরজাফরিও বটে। বাংলাদেশের মিডিয়া এ ক্ষেত্রে ভীষণ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিচ্ছে। তারা অর্জুন রামপালদের নিয়ে যতো নিউজ প্রকাশ করছে এখন, তারচে কম প্রকাশ করছে সুন্দরবনের রামপাল প্রকল্প নিয়ে খবর। এখানেই দায়িত্বশীলতার বড় পরিচয়।
এই বাংলাদেশের বাইরে অন্য কোনোদেশে এই রামপাল প্রকল্প হলে দেখা যেতো মিডিয়া প্রতিদিনই ‘রামপাল রামপাল করে’ মাথা নষ্ট করে ফেলতো। সাপ-ব্যাঙ-কুমির-বাঘের অভয়ারণ্যের জন্য তারা ঘুম হারাম করে ফেলত। কিন্তু আমাদের মিডিয়া এটা সুন্দরভাবে বুঝতে পেরেছে। তাই তারা ক্ষতিকর বাঘ-কুমির, সাপ-ব্যাঙ-গুইসাপদের পক্ষে নেই।
উল্লেখ্য, ২০০ বছর আগেও সুন্দরবনের মোট আয়তন ছিল প্রায় ১৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার। বর্তমানে সমাজহিতৈষী নানা সরকার ও স্থানীয় প্রভাবশালী ভাল মানুষদের তৎপরতায় এটা দাঁড়িয়েছে এখন ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটারে। আগামি ৫০ বছরে এটিকে ঐতিহাসিক ৭১ বর্গ কিলোমিটারে নিয়ে আসা হবে। তখন সুন্দরবন হয়ে যাবে কিউট সাইজের এক সাফারি পার্ক।
যেহেতু আধুনিক মানুষদের কাছে বনের চেয়ে সাফারি পার্কের কদর বেশি, ফলে দেশের লোকজন তখন সুন্দরবন সাফারি পার্কের ভেতর দিয়ে গিয়ে একেবারে সমুদ্রের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে সাগরের সাথে সেলফি তুলতে পারবেন। নয়নাভিরাম সূর্যাস্ত দৃশ্য দেখে তখন বলে উঠতে পারবেন, ‘ওয়াও! বহুত আচ্ছা হ্যায়। কুল হ্যায়।’
লুৎফর রহমান হিমেল : সাংবাদিক, কলামিস্ট। বার্তা সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

Sunday, April 29, 2018

সুন্দরবন আমাদের গর্ব। প্রাকৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ এটি। কিন্তু আপনি কি কখনো ভেবেছেন এর নাম সুন্দরবন কেন? বনটি সুন্দর, তাই? নাকি সুন্দরী গাছের জন্য? এ নিয়ে আছে নানান মত। অনেকে মনে করেন, নামটির আক্ষরিক শব্দেই রয়েছে মূল কথা। সুন্দরবন অর্থ সুন্দর জঙ্গল বা সুন্দর বনভূমি। আর আমাদের সুন্দরবনের সৌন্দর্য্য যে অতুলনীয় তা তো বলারই অপেক্ষা রাখে না।
 
সুন্দরবন নামের সম্ভাব্য আরেকটি কারণ মনে করা হয় সমুদ্রকে। সমুদ্রের তীরে বনের অবস্থান বলে 'সমুদ্র বন' থেকে কালক্রমে এর নাম হয়েছে সুন্দরবন এমনটি ধারণা করেন অনেকে।
 
তবে বিশাল এক জনমত আছে সুন্দরী গাছের পক্ষে। এই বনে অসংখ্য সুন্দরী গাছ জন্মে। বনের স্থানীয়দের ঘর তৈরি, ঘরের ছাউনি দেওয়ার গাছে এই গাছের বড় বড় পাতা খুবই কাজে দেয়। শুধু তাই নয়, এখানকার বিখ্যাত সুন্দরী গাছের মূলে রয়েছে ডায়াবেটিস প্রতিরোধী ওষুধ। স্থানীদের জোরালো যুক্তি, এই বনের নামের সাথে জড়িত সুন্দরী গাছই।
 
তবে নামের রহস্য যাই হোক না কেন সুন্দরবন ভ্রমণ এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। সুন্দরবনকে জালের মত জড়িয়ে রয়েছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, কাদা চর এবং ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবণাক্ততাসহ ক্ষুদ্রায়তন দ্বীপমালা।
 
মোট বনভূমির ৩১.১ শতাংশ, অর্থাৎ ১,৮৭৪ বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে নদীনালা, খাঁড়ি, বিল মিলিয়ে জলাকীর্ণ অঞ্চল। বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল হলেও বাঘ মামার দেখা পাওয়া খুবই কঠিন। তবে দেখা পাবেন হরিণ, বানরসহ নানান বণ্য প্রাণীর। অসংখ্য পাখির কলকাকলি আর পাতার ফাঁকে বয়ে চলা বাতাসের শব্দ সত্যিই রোমাঞ্চকর। একবার হলেও অবশ্যই ভ্রমণ করবেন অপরূপ এই বনটি।
সল্প খরচে এবং একদিনেই যারা সুন্দরবন ভ্রমণ করতে চান তাদের জন্য একটি আদর্শ দর্শনীয় স্থান ‘করমজল’ ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্র।
সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের অধীন করমজল পর্যটন কেন্দ্রটি ভ্রমন পিপাসুদের কাছে একটি আকর্ষণীয় স্থান। ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্র ছাড়াও এখানে রয়েছে হরিণ ও কুমির প্রজনন ও লালন পালন কেন্দ্র।
বাগেরহাটের মংলা উপজেলা সদর বা মংলা বন্দর থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় চড়ে করমজলের জেটিতে পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র এক থেকে দেড় ঘণ্টা। নদী পথে মংলা থেকে দূরত্ব প্রায় ৮ কিলোমিটার আর খুলনা থেকে প্রায় ৬০ কি.মি.।
KoromJolএখানে প্রবেশপথেই মাটিতে শোয়ানো বিশালাকৃতির মানচিত্র সুন্দরবন সম্পর্কে সাম্যক ধারণা দেবে। মানচিত্রটিকে পেছনে ফেলে বনের মধ্যে দক্ষিণে চলে গেছে আঁকাবাঁকা কাঠের তৈরি হাঁটা পথ। এই নাম ‘মাঙ্কি ট্রেইল’।
এই নামের স্বার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায় ট্রেইলে পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই। পুরো ট্রেইল জুড়েই দেখা মিলবে সুন্দরবনের অন্যতম বাসিন্দা রেসাস বানরের। বানরগুলো ট্যুরিস্টদের কাছাকাছি চলে আসে। হাতে কলা বা অন্য কোনো খাবার নিয়ে পথ না চলাই ভালো। কারণ বানরগুলো খাবারের জন্য আপনাকে ঘিরে ধরতে পারে। তাই সাবধান বানর থেকে।
karamjal-Sundarban-Pic-003কাঠ বিছানো পথের দুই ধারে ঘন জঙ্গল। দুই পাশে বাইন, কেওড়া আর সুন্দরী গাছের সারি। তবে বাইন গাছের সংখ্যা বেশি। কাঠের পথটি কিছু দূর যাওয়ার পর হাতের বাঁয়ে শাখা পথ গিয়ে থেমেছে পশুরের তীরে। শেষ মাথায় নদীর তীরে বেঞ্চ পাতানো ছাউনি। মূল পথটি আরও প্রায় আধা কিলোমিটার দক্ষিণে গিয়ে ছোট খালের পাড়ে থেমেছে।
এ পথের মাথায় গোলপাতার ছাউনির গোলাকৃতির আরও একটি শেইড। যেখানে বেঞ্চে বসে বনের নিস্তব্ধতা উপভোগ করা যাবে।
সেখান থেকে আবারও পশ্চিম দিকে কাঠের ট্রেইলটি চলে গেছে কুমির প্রজনন কেন্দ্রের পাশে। এই ট্রেইলের মাঝামাঝি জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার (বুরুজ)।  করমজলে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে একটি সুউচ্চ ওয়াচ টাওয়ার। এর চূড়ায় থেকে করমজল এবং চারপাশটা ভালো করে দেখা যায়।
KaromJol-Pic-002সুন্দরবনের উপরিভাগের সবুজাভ নয়নাভিরাম এ দৃশ্য দেখে যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য।
কাঠের তৈরি ট্রেইলের একেবারে শেষ প্রান্তে কুমির প্রজনন কেন্দ্র। সেখান থেকে সামান্য পশ্চিম দিকে হরিণ ও কুমিরের প্রজনন কেন্দ্র। সামনেই ছোট ছোট অনেকগুলো চৌবাচ্চা। কোনটিতে ডিম ফুটে বের হওয়া কুমির ছানা, কোনটিতে মাঝারি আকৃতির আবার কোনটিতে আরও একটু বড় বয়সের লোনা জলের কুমিরের বাচ্চা।
একেবারে দক্ষিণ পাশে দেয়াল ঘেরা বড় পুকুরে আছে রোমিও, জুলিয়েট আর পিলপিল। লবণ পানির প্রজাতির কুমিরের প্রজনন বৃদ্ধি ও লালন-পালনের জন্য সুন্দরবনস বায়োডাইভার্সিটি কনজারভেশন প্রকল্পের আওতায় ২০০২ সালে পূর্ব সুন্দরবনের করমজল পর্যটন কেন্দ্রে ৮ একর জমির ওপর বনবিভাগের উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় দেশের একমাত্র সরকারি এই কুমির প্রজনন কেন্দ্র।
Crocodile-in-Sundorbonওই বছর সুন্দরবনের বিভিন্ন নদীতে জেলেদের জালে আটকা পড়া ছোট-বড় পাঁচটি লোনা পানির কুমির নিয়ে কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হয়। রোমিও-জুলিয়েটের বয়স এখন ২৪। এই জুটি প্রজননক্ষম হয় ২০০৫ সালে।
জুলিয়েট আকারে রোমিওর চেয়ে সামান্য ছোট। লোনা পানির এই প্রজাতির কুমির ৮০ থেকে ১০০ বছর বাঁচে। এই কেন্দ্রটি তত্ত্বাবধানে ছিলেন (২০১৪ সাল) অষ্ট্রেলিয়ার আন্তর্জাতিক ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সেন্টারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এক জন বন কর্মকর্তা।
CROCODILE-in-SundorBonজুলিয়েট এ পর্যন্ত (মে ২০১৫) ডিম দিয়েছে মোট ৫৩২টি। সেখান থেকে ২৮৪টি (ডিসেম্বর ২০১৪) বাচ্চা ফুটিয়েছেন বন্য প্রাণী প্রজনন ও সংরক্ষণ কেন্দ্রের কর্মীরা। করমজল বন্য প্রাণী প্রজনন ও সংরক্ষণ কেন্দ্রের আরেক নারী সদস্য পিলপিল। এখন পর্যন্ত সে ডিম দিয়েছে ৪৪টি, যা থেকে বাচ্চা ফুটেছে ৩৩টি।
এর পাশেই চোখে পড়বে চিড়িয়াখানার মতো উপরিভাগ উন্মুক্ত খাচায় ঘেরা খোলা জায়গা। ভেতরে চিত্রা হরিণ। খাঁচার ভেতরে পশ্চিম কোণে ছোট আরেকটি খাঁচা। ভেতরে রয়েছে কয়েকটি রেসাস বানর।
সাম্প্রতি (২০১৫ সালে) আই.ইউ.সি.এন (IUCN) প্রকল্পের আওতায় বাচ্চা উৎপাদনের উদ্যেশ্যে ‘করমজল বন্য প্রাণী প্রজনন কেন্দ্রে’র পুকুরে  ছাড়া হয়েছে ছাড়া হয়েছে ১৪টি কচ্ছপ।
  • প্রয়োজনীয় তথ্য
করমজলে দেশি পর্যটকের জন্য প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি ২০ টাকা, বিদেশী পর্যটক ৩শ’ টাকা। দেশি ছাত্র ২০ টাকা। দেশি গবেষক ৪০ টাকা। বিদেশী গবেষক জনপ্রতি ৫শ’ টাকা। অপ্রাপ্ত বয়স্ক (বারো বছরের নিচে) ১০ টাকা। দেশি পর্যটকের ভিডিও ক্যামেরা ব্যবহারে ক্যামেরা প্রতি ২শ’ টাকা। বিদেশি পর্যটক ৩শ’ টাকা। সব মূল্যের সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রযোজ্য।
karamjal-Sundarban-Pic-02করমজল যেতে হয় পশুর নদী পাড়ি দিয়ে। এই নদী সবসময়ই কম-বেশি উত্তাল থাকে। তাই ভালো মানের ইঞ্জিন নৌকা নিয়ে যাওয়া উচিৎ। আগেই নিশ্চিত হয়ে নিন নৌকায় পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট ও লাইফ বয়া আছে কী না।
বন রক্ষী ছাড়া জঙ্গলের ভেতরে ঢুকবেন না। হরিণ ও কুমির প্রজনন কেন্দ্রের কোন প্রাণীকে খাবার দিবেন না।
  • কীভাবে যাবেন
সুন্দরবনের ‘করমজল’ ইকো-ট্যুরিজম (পর্যটন) কেন্দ্রে যাবার জন্য সব চেয়ে সহজ মংলা থেকে নদী পথে যাওয়া। এছাড়া খুলনা থেকেও নদী পথে যেতে পারেন করমজল। দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে সড়ক পথে আপনি আসতে পারবেন বাগেরহাটের মংলায়। মংলা থেকে ইঞ্জিন নৌকায় চড়ে যেতে হবে করমজল।
KoromZol-Sundorbonদশ জনের উপযোগী একটি ইঞ্জিন নৌকার যাওয়া আসার ভাড়া পড়বে ৭শ’ (৭০০) থেকে ১ হাজার ২শ’ টাকা। এসব ইঞ্জিন নৌকাগুলো সাধারণত ছাড়ে মংলা ফেরি ঘাট থেকে।
  • কোথায় থাকবেন
সারাদিন করমজলে বেড়িয়ে রাতে এসে থাকতে পারেন বন্দর শহর মংলায়। এখানে আছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মোটেল পশুর (০৪৬৬২-৭৫১০০) ছাড়াও বেশ কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি রেস্ট হাউস হোটেল-মোটেল। রুম (ডাবল) প্রতি ভাড়া পড়বে ৮শ’ থেকে ২ হাজার টাকা (নন এসি/এসি)।
ইকনোমি বেড ৬শ’ টাকা। এছাড়াও মংলা শহরে সাধারণ মানের কিছু হোটেল আছে। এসব হোটেলে দেড়শ’ থেকে ৬শ’ টাকায় কক্ষ পাওয়া যাবে।
সুন্দরবনের করমজল প্রজনন কেন্দ্র, পিপাসু মেধার অজানা তথ্য। বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের বন্যপ্রাণি ইকোট্যুরিস্ট করমজলে প্রজনন কেন্দ্রের বানর-হরিণ, কচ্ছপ ও কুমিরসহ প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মুগ্ধ দর্শনার্থীরা। বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের করমজল দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে। এই স্থানটিতে দর্শনার্থীদের ভিড় থাকে চোখে পড়ার মত।
সুন্দরবনের করমজল প্রজনন কেন্দ্র, পিপাসু মেধার অজানা তথ্য
আত্মীয় স্বজন ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সুন্দরবনের করমজলে এই পর্যটন মৌসুমে এলাকাটি ঘুরে আনন্দ-উপভোগ করছেন। সুন্দরবন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, করমজলে হরিণ ও কুমির প্রজনন কেন্দ্রে যদি ডলফিনের প্রদর্শনি করা সম্ভব হয় এবং বনে যেসব অরকিড আছে সেগুলোর বাটার ফ্লাইয়ের গার্ডেন করে একটু বৈচিত্র্য আনতে পারলে আরও দর্শানার্থী বাড়বে।
সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া পলিটেকনিকেলের শিক্ষার্র্থী আব্দুল মমিন বলেন, আমরা ৪৬ জনের একটি টিম আসছি। বইতে পড়েছি সুন্দরবন সম্পর্কে, কিন্ত আজ স্বচক্ষে দেখে খুবই ভাল লেগেছে। এখানকার প্রাকৃতিক বনের সৌদর্য আলদা বৈশিষ্টের, না দেখলে বুঝানো যাবে না। অনেক কিছু দেখলাম, অনেক মজা করেছি।
ফরিদপুর থেকে আসা গৃহবধূ তায়শা ইসলাম বলেন, সুন্দরবনে প্রথম এসে হরিন, বানর, কুমির, বিলুপ্ত প্রজাতির কচ্ছপ ও নানা পশুপাখি দেখে মুগ্ধ হয়েছি। যারা সুন্দরবনে আসেননি, তারা সুন্দরবন ঘুরে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন। এই বনের আলাদা বৈশিষ্ট রয়েছে।
সুন্দরবনের করমজল প্রজনন কেন্দ্র
তবে অনেক দর্শনার্থীদের অভিযোগ, ট্যুরিজম এলাকায় দর্শনার্থীদের বসার টুলের ব্যবস্থা নেই, ফুট ট্রেইল ও ওয়াচ টাওয়ারটি নাজুক। একারণে দর্শনার্থীদের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হয়। এখানে অবকাঠামোর উন্নত ব্যবস্থা থাকলে দর্শনার্থীরা ভালোভাবে সুন্দরবন ঘুরে দেখতে পারতো।
বাগেরহাটের মোংলা বন্দর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে পূর্ব সুন্দরবনের করমজলে বন্যপ্রাণি ইকোট্যুরিজম সেন্টার হওয়ায় প্রতিনিয়ত দেশ-বিদেশের প্রতিবেশ পর্যটকরা আসছে নৈসর্গ উপভোগ করতে। সুন্দবনের বানর, হরিণ ও কুমিরসহ পশু-পাখি খুব কাছ থেকে দেখা ও স্পর্শ করা যায়। এছাড়া বনের সৌন্দার্য দেখার জন্য রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। একারণে সহসাই বনের দৃশ্যগুলো দেখে দর্শনার্থীর মুগ্ধ। অনেক দর্শনার্থীরা বনের অবিরাম দৃশ্যগুলো ধারন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
সুন্দরবনের করমজল প্রজনন কেন্দ্র, পিপাসু মেধার অজানা তথ্য
কিছু সমস্যার কথা স্বীকার করে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের করমজল বন্যপ্রানী ইকোট্যুরিজমের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, এসএসসির পরীক্ষা শেষ হওয়ায় দর্শনার্থীদের সংখ্যা বাড়ছে। শুক্রবার দর্শানর্থীদের সামাল দিতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়েছে। পর্যটক মৌসুমে এখানে দুটি ঘাট যথেষ্ট নয়। আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে নতুন কিছু অবকাঠামো নির্মানের। যাতে ঘুরতে এসে কোন দর্শনার্থীদের বিড়ম্বনায় পড়তে না হয়।

বাংলাদেশের জাতীয় পশুর নাম কী? উত্তর – রয়েল বেঙ্গল টাইগার। কোথায় দেখা যায় রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে? উত্তর – সুন্দরবনে। কেন সুন্দরবন ? সে বনে সুন্দরী গাছের উপস্থিতির কারণে। সেখানে আর কী পাওয়া যায়? মধু পাওয়া যায়। আসলে  সুন্দরবনে কী পাওয়া যায় না-এটা একটা প্রশ্ন হতে পারে! আসুন জেনে নেওয়া যাক অজানা তথ্যের ভাণ্ডার প্রকৃতিকন্যা সুন্দরবন ও সুন্দরববনের মধু সম্পর্কে।

সুন্দরববন

সুন্দরবন হচ্ছে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় অবস্থিত পৃথিবীর একমাত্র বৃহত্তম প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বন।  এ বন বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে অবস্থিত। সুন্দরবনের মোট আয়তন ১০০০০ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে আমাদের দেশের মধ্যের অংশের আয়তন প্রায় ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার।  বর্তমানে মোট ভূমির আয়তন ৪,১৪৩ বর্গ কিলোমিটার (বালুতট ৪২ বর্গ কি.মি. -এর আয়তনসহ) এবং নদী, খাঁড়ি ও খালসহ বাকি জলধারার আয়তন ১,৮৭৪ বর্গ কি.মি. ।
“সুন্দরবন”-এর আক্ষরিক অর্থ “সুন্দর জঙ্গল” বা “সুন্দর বনভূমি”। খুব সম্ভবত ‘সুন্দরবন’ নামটি সুন্দরী বৃক্ষের আধিক্যের কারণে (সুন্দরী-বন) অথবা সাগরের বন (সমুদ্র-বন) এখান থেকে এসেছে। সাধারণভাবে গৃহীত ব্যাখ্যাটি হলো এখানকার প্রধান উদ্ভিদ সুন্দরী বৃক্ষের (Heritiera fomes) নাম থেকেই এ বনভূমির নামকরণ।

সুন্দরববনের জীববৈচিত্র

জীববৈচিত্রের আধার এই সুন্দরবন। এখানে পাওয়া যাওয়া গাছের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সুন্দরী, গেওয়া, গরান এবং কেওড়া গাছ। উল্লেখযোগ্য বন্যপ্রাণীর মধ্যে শুরু হল রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, বানর, শুকর, কুমির, ডলফিন, গুইসাপ, অজগর, হরিয়াল, বালিহাঁস, গাংচিল, বক, মদনটাক, মরালিহাঁস, চখা, ঈগল, চিল মাছরাঙা ইত্যাদি। এ বন দেশের মৎস্য সম্পদেরও এক বিরাট আধার। ইলিশ, লইট্টা, ছুরি, পোয়া,  রূপচাঁদা, ভেটকি, পারসে, গলদা, বাগদা, চিতরা ইত্যাদি মাছ পাওয়া যায়। এছাড়া এ বনের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত প্রধান প্রধান নদীগুলো হলো- পশুর, শিবসা, বলেশ্বর, রায়মংগল ইত্যাদি। তাছাড়া শত শত খাল এ বনের মধ্যে জালের মতো ছড়িয়ে আছে।
এখানে বলতে হয় যে, বিশ্ব ঐতিহ্যে সুন্দরবন জায়গা করে নিয়েছে। ১৯৯২ সালের ২১শে মে সুন্দরবন রামসার স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সুন্দরবন ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্বের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
সুন্দরবনের জনসংখ্যার বেশির ভাগই স্থায়ী নয়। এ বন দেশের বনজ সম্পদের সবচেয়ে বড় উৎস। কাঠের উপর নির্ভরশীল সকল শিল্পের কাঁচামাল জোগান দেয় এই বন। এছাড়া এ বন থেকে নিয়মিত ব্যাপকভাবে আহরণ করা হয় ঘর ছাওয়ার পাতা, মধু, মৌচাকের মোম, মাছ, কাঁকড়া এবং শামুক-ঝিনুক।

সুন্দরববনের মধু

দেশে মধু উৎপাদনের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে সুন্দরবন। ১৮৬০ সাল থেকে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করা হয়। বনসংলগ্ন একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী বংশপরম্পরায় মধু সংগ্রহ করে। এদেরকেই মৌয়াল বলা হয়। দেশে উৎপাদিত  মোট মধুর ২০% সুন্দরবনে পাওয়া যায়। সুন্দরবনের সবচেয়ে ভালো মানের মধু খোলসী ফুলের ‘পদ্ম মধু’। মানের দিক থেকে এরপরেই গরান ও গর্জন ফুলের ‘বালিহার মধু’। মৌসুমের একেবারে শেষে আসা কেওড়া ও গেওয়া ফুলের মধু অপেক্ষাকৃত কম সুস্বাদু।
মধু সংগ্রহের জন্য প্রতিবছরের ১ এপ্রিল থেকে তিন মাসের (এপ্রিল, মে ও জুন) জন্য বন বিভাগ মৌয়ালদের অনুমতিপত্র (পাস) দেয়। আর সময় নষ্ট না করে শুরুর দিন থেকেই মধু সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মৌয়ালরা।
মধু সংগ্রহ করতে যাওয়ার আগে বিশেষ প্রার্থনা করে নেন মৌয়ালরা ৷  কারণ সেখানে বাঘের ভয়ের পাশাপাশি আছে ডাকাতের ভয় ৷ কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যান৷ মধু সংগ্রহের কিছু নিয়মনীতি ঠিক করে দিয়েছে বন বিভাগ, যেমন- মৌচাক থেকে মৌমাছি সরানোর সময় আগুনের ধোঁয়া ব্যবহার করতে হবে – এরকম নিয়ম আছে৷
মৌয়ালরা এখন সনাতন পদ্ধতির পাশাপাশি হাইজেনিক পদ্ধতিতেও সুন্দরবন থেকে মধু ও মোম সংগ্রহ করছে। যার ফলে মধু ও মোম সংগ্রহের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে । পরিচ্ছন্নভাবে মধু সংগ্রহ এবং এর গুণগত মানও বজায় রাখার জন্য বেসরকারি সংগঠনগুলো মৌয়ালদের যন্ত্রপাতি বিতরণ করছে।
মধু নিয়ে এত কথা হচ্ছে, আপনি জানেন মধু কী ?  মধু হচ্ছে একটি তরল আঠালো মিষ্টি জাতীয় পদার্থ, যা মৌমাছিরা ফুল থেকে পুষ্পরস হিসেবে সংগ্রহ করে মৌচাকে জমা রাখে । পরবর্তীতে জমাকৃত পুষ্পরস প্রাকৃতিক নিয়মেই মৌমাছি বিশেষ প্রক্রিয়ায় পূর্ণাঙ্গ মধুতে রূপান্তর এবং কোষবদ্ধ অবস্থায় মৌচাকে সংরক্ষণ করে । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে মধু হচ্ছে এমন একটি মিষ্টি জাতীয় পদার্থ যা মৌমাছিরা ফুলের পুষ্পরস অথবা জীবন্ত গাছপালার নির্গত রস থেকে সংগ্রহ করে মধুতে রূপান্তর করে এবং সুনির্দিষ্ট কিছু উপাদান যোগ করে মৌচাকে সংরক্ষণ করে।
কেন সুন্দরববনের মধু এত গুরুত্বপূর্ণ?  একারণ হিসেবে বলা যায় – মধু শক্তি প্রদায়ী, হজমে সহায়তা, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, ফুসফুসের যাবতীয় রোগ ও শ্বাসকষ্ট নিরাময়ে করে। মধুতে রয়েছে ভিটামিন যা  অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে কাজ করে। মধুতে প্রায় ৪৫টি খাদ্য উপাদান থাকে।
মধুর এত গুণ থাকা পরেও বাজারের মধু খাঁটি কিনা আপনি জানেন কি? অনেকেই বলবেন, না। খাবারের তালিকাভুক্ত ৪৩ ধরনের পণ্যে শতকরা ৪০ ভাগ ভেজালের সন্ধান পেয়েছে জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট (আইপিএইচ) এবং এর মধ্যে ১৩টি পণ্যে ভেজালের হার প্রায় শতভাগ।
প্রশ্ন করতে পারেন, খাঁটি মধু তবে কি পাওয়া যাবে না ? উত্তরে বলব, হ্যাঁ পাওয়া যাবে। বর্তমানে সুন্দরবন থেকে হাইজেনিক পদ্ধতিতে মধু আহরণ করা হয়, যা খাঁটি এবং সেই সাথে khaasfood.com থেকে খাঁটি সুন্দরববনের মধু পাবেন। 

আগে শুনতাম মানুষের মুখে। বন্ধু প্রিয়জন কিংবা আত্মীয়স্বজনের কাছে। ভাবতাম স্মৃতির আঙ্গিনার এ পাশে থেকে ও পাশ ছুটে বেড়াতাম। দু’চোখ ভরা স্বপ্নে বিভোর হতাম। কত না সুন্দর! সুন্দর সেই সবুজ বনটি, কত না মনোরমে সাজানো কে জানি, কী আছে তাতে? কেন মানুষ তার প্রশংসায় উল্লসিত? কেন দৌড়ঝাঁপ চলছে তাকে সপ্তাযেêর একটি বানাতে? হাজারো প্রশ্ন এসে জমা হতো হূদয়-কোণে।

অদূর আকাশের শূন্যতায় একটি ছবি আঁকতাম। কখন সময় হবে? কখন ছুটে যাবো ওই সবুজ বনের ধারে? অধীর আকাঙ্ক্ষার প্রহর কেন বারবার নাড়া দিচ্ছিল। আর কত দেরি? অবশেষে অপেক্ষা শেষ হলো। প্রিয়জন ছুটে যাচ্ছে ওই গভীর অরণ্যে? গভীর সে বন, মাঝে মধ্যে আঁকাবাঁকা পথ। বাঘের গজêন, বানরের লাফালাফি, হরিণের দৌড়ঝাঁপ, সারি সারি বৃক্ষরাজি, নানা ধরনের ঝোপ­ এ যেন অন্য রকম এক আনন্দ! সত্যি, বণêনাহীন সুন্দরের মালা পরে সেজে আছে গভীর অরণ্যের সুন্দরবন।

২৮ ফেব্রুয়ারি উল্লসিত প্রিয়জনরা ট্রেন ছাড়ার আধঘণ্টা আগেই ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে পৌঁছে যায়। সবার চোখেমুখে এক অন্য রকম আনন্দের আভা ফুটে আছে। হাসিমাখা রহস্যবাক্যে আমাদের ছুটে চলাকে আরো আনন্দময়ী করে তোলে।

স্টেশনে নয়া দিগন্ত দাউদকান্দি প্রতিনিধি হানিফ ভাইয়ের সাথে দেখা। তিনি হেলান দিয়ে বসে আছেন আর পান চিবুচ্ছেন। তার আশপাশে আরো কয়েকজন। কেউ ব্যাগ নিয়ে টানাটানি করছে। কেউ খুঁজছে বি.সকে। কারণ কত নম্বর বগিতে টিকিট তা তিনি ছাড়া কেউ জানে না। তা ছাড়া অনেক প্রিয়জন এর আগে কখনো ট্রেনেই ভ্রমণ করেনি­ তাদের আগ্রহ আরো বেশি।

স্টেশনের এক পাশে বি.সকে দেখা গেল। তিনি বেশ উদাস। সকালে তার নানী মারা গেছেন। তাকে দাফন করে সোজা স্টেশনে এসেছেন তিনি।

থপাস করে কিসের আওয়াজ হলো? বুঝলাম বিগম্যান প্রিয়জন জাহাঙ্গীর প্লাটফমেê হাঁটাহাঁটি করছেন। তার পেছনে সুমন-নাঈমসহ আরো অনেক প্রিয়জন দাঁড়িয়ে। প্রিয়জন সুমন বললেন, আনন্দ উৎসবের ব্যান্ডপাটিê নেই এটা কেমন কথা। অন্তত একটা ঢোল থাকলেও চলত। কথাটা শুনে সবাই হেসে ওঠে। এবার হাসির রোল পড়ল দ্বিগুণ। এরই মাঝে এসে পৌঁছে গেল প্রিয়জন ইলিয়াস। তিনি সবার জন্য সিঙ্গাড়া আর ডিম এনেছেন। কিন্তু এত সব আয়োজনের কী দরকার তা পরিষ্কারভাবে বোঝা গেল না।

ট্রেন ছাড়ার আগে ছোটখাটো একটা আড্ডা বসল প্লাটফমেê। সেখানেই বি.স ইলিয়াসের হাতে তুলে দিলেন প্রিয়জনের পক্ষ থেকে ফতুয়া উপহার। ইলিয়াস এতেও খুশি হতে পারল না। কারণ এই আনন্দ আয়োজনে তিনি আমাদের সাথে যেতে পারছেন না। মৃতুøর কোল থেকে ফিরে আসা এই মানুষটি প্রিয়জনদের এক নজর দেখতে তাদের সামান্য একটু আপ্যায়নে নিজেকে অল্প তৃপ্তে ধন্য করতে বহু কষ্ট করে স্টেশনে ছুটে এলেন। ইলিয়াস ভাইয়ের এমন আন্তরিকতা আমাদের যাত্রাকে আরো আনন্দময়ী করে তুলেছে। তবে সন্ধ্যার পর থেকেই স্টেশনে কারন্টে ছিল না। কেমন জানি একটা ভুতুড়ে অবস্থা হয়ে আছে। অন্ধকার। তবে অদ্ভুত আকাশের উদিত চাঁদমামার হাসিতে আমরা একটু স্বস্তি পাচ্ছিলাম।

ট্রেন এলে সবাই দ্রুত দৌড়ে ছুটেছে আলোকিত ট্রেনে নিজ আসনটি বেছে নিতে। আমরা প্রিয়জনরা সবাই এক সাথে দাঁড়িয়ে। জানা গেল আমাদের সিট ‘ঙ’ নম্বর বগিতে। ‘ঙ’ নম্বর বগি খুঁজতে সবাই ব্যস্ত। কিন্তু একি! ‘ঙ’ গেল কোথায়। আদশêলিপি তিনবার পড়ি, তিনবাপরই ‘ঘ’-এর পর ‘ঙ’ আসে। কোনোবারই ‘চ’ খুঁজে পাইনি। কিন্তু এখানে দেখি উল্টো সিস্টেম। ‘ঘ’-এর পরে ‘চ’ তারপর ‘ঙ’।

ট্রেনে ওঠার পরই বুঝলাম আজ রাত কেউ ঘুমাবে না। তারপর চাঁদমামা যেভাবে হাসছে তাতে কারে ঘুম আসার কথা না। তার পরও শামিম আহমেদ, আরিফুল ইসলাম, নুসরাত জাহান, সাদিয়া, কফিল উদ্দীন, আবদুল মান্নান, নাজমা আত্ত্নার, মেহেদী হাসান, শরিফুল ইসলাম, জসিমউদ্দীন, মামুন মিয়া, কামরুল হাসান, কবি ফজলুল হক, আবদুল বাতেন, কারিমা আত্ত্নার, রফিকুল ইসলাম, লালবাগের শফিকুল ইসলাম আয়েশ করে বসে পড়ল সিটে। বোঝাই যাচ্ছে ট্রেন ছাড়ার সাথে সাথে তারা নিদ্রাপুরিতে যেতে চায়। কিন্তু তার আগেই সিট নিয়ে নানান ঝামেলা শুরু হলো। ট্রেনে সিটবিহীন যাত্রীর সংখ্যা অনেক। তাদেরই একজন এসে বসেছে প্রিয়জনের সিটে। তাকে কিছুতেই তুলে দেয়া যাচ্ছে না। তবে সিট নিয়ে যত সমস্যাই হোক ট্রেন ছাড়ল সময়মতো। বেশ অবাকই হলাম। ভাবতেই ভালো লাগে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।

দাউদকান্দি প্রিয়জনের মোঃ হানিফ খান, মোস্তাফিজুর রহমান, কাজী হেলাল, মোঃ রুহুল আমিন, শরীফুজ্জামান জসিম, মোঃ হাছান খান, মাহবুবা ইসলাম বেছে বেছে ভালো সিট নিয়েছেন­ এমন অভিযোগ পেলাম। ট্রেনের মাঝ বরাবর ব্যানার ঝুলিয়ে দেয়া হলো। সেই বগিতে উঠে তিনিই কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। এমন কি টিকিট চেকার এসেও কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। এত চিল্লাপাল্লা করছে সবাই তার পরও সবাই যেন মজাই পাচ্ছে। কেউ বিরত্ত্ন না।

রাতে সবাই এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল। এমন সময় কোত্থেকে এক মহিলা এসে হাউকাউ শুরু করে দিলো। বিরত্ত্ন প্রিয়জনদের অনেকেই ছুটে গেল। কিন্তু কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই মহিলার। আসলে কমনসেন্স না থাকলে যা হয়। গভীর রাতে ট্রেন যখন বঙ্গবন্ধু সেতু আর হাডিêঞ্জ ব্রিজ পার হচ্ছিল তখন সবাই ভিড় করল জানালায়। তীব্র শীতের বাতাসও তাদের দমিয়ে রাখতে পারেনি।

খুলনা পৌঁছলাম ভোর ৪টায়। আনন্দ যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেল। সকালের খাবার কখন খাবো সেই চিন্তা কারো নেই। কখন খুলনা প্রিয়জন বাস নিয়ে আসবে এটাই যেন শেষ কথা। তবে খুলনার মুন্না যে বাস নিয়ে এলো তাকে ঠিক বাস বলা ঠিক না। টেম্পো বলা যায়।

সকালের নাশতার পর মুন্নার আনা পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট বাসটায় চড়ে আমরা পৌঁছলাম মংলায়। রাস্তায় বারবার মুন্না বলছিল, রূপসা নদীর তীরে নাকি তার শ্বশুরবাড়ি। এই শুনে বি.স বললেন, এই দুনিয়ায় তিনজনের কেবল বউ আছে, একটা হলে নাঈম, আর বাকি দু’জন হলো জসিম ভাই আর মুন্না। সুন্দরবনে আমরা পৌঁছলাম বেলা ২টায়। দুটো বড় বড় ট্রলারে চড়েই গেলাম। তারপর প্রিয়জন আরিফ যে ট্রলারে উঠে সেটাই এক দিকে কাত হয়ে যায়। প্রিয়জন নজরুল ইসলাম তো ভয়েই বললেন, ভাই দয়া করে তুমি মাঝখানে বসো। নইলে সুন্দরবন আর পৌঁছতে হবে না।

সুন্দরবন পৌঁছেই সবাই ছুটতে শুরু করল। কাউকে ধরে রাখাই মুশকিল। তারপর বি.স সবাইকে নিয়ে ফটোসেশন সেরে নিলেন। দল বেঁধে সবাইকে দেখতে বললেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা! কেউ একাই ছুটে চলল। কেউ গাছে উঠে বাঘ দেখার চেষ্টা করল। কেউ হেতালগাছের সাথে হেলান দিয়ে তাল হারিয়ে ছবি তুলল। এই তালহারা কয়েক প্রিয়জন একটা মৌচাকে ঢিল ছুড়তেই যত বিপত্তি। ভ্যাগ্যিস এ যাত্রা বেঁচেছে তারা।

সুন্দরবনের মধ্যে হেঁটেচলা একটু কষ্টকর। কারণ পুরো সুন্দরবনের মাটিই শাঁসমূলে ভরা। কয়েকজন অবশ্য এই শাঁসমূল কি তাই বোঝেনি। বলল, এত ছোট ছোট গাছ কেন? ঘাস থাকলে হাঁটতে সুবিধা হতো।

কয়েক প্রিয়জন নামল গাছ শনাত্ত্ন করতে। সুন্দরী গাছ কোনটা এ নিয়ে তুমুল বিতকê শুরু হলো। একজন গোলপাতা গাছ দেখিয়ে বলল, ওটাই সুন্দরী গাছ।

বনের কিছুটা ভেতরে আমরা পেলাম হেতালগাছের ঝোপ। সবুজ সুন্দর এই দৃশ্যে সবার দৃষ্টি আটকে গেল। এখানেই বি.স টপ্পা খেলার আয়োজন করলেন। যে জিতবে সেই পাবে ফতুয়া পুরস্কার। খুলনা প্রিয়জনের হুমায়ুন কবীর ও লিনা এবং ঢাকা প্রিয়জনের কামরুজ্জামান পেল পুরস্কার। এ ছাড়া পুরস্কার জিতে নেয় শিশু প্রিয়জন মেহজাবিন বিনতে সুমাইয়া।

আমরা ফিরে এলাম সন্ধ্যায়। আসার পথে পশুর নদীর মনোরম দৃশ্য উপভোগ করলাম। এরই মধ্যে কয়েকজন দেখে এলো মংলা বন্দর। রাতে ফিরে এলাম এস এস ফাউন্ডেশনের অফিসে। সেখানে বসল আলোচনার আসর। বি.স এস এস ফাউন্ডেশনের পরিচালকের হাতে উপহারস্বরূপ তুলে দিলেন প্রিয়জন গিফট বক্স। এ ছাড়া গল্প নিয়ে আয়োজন করা হলো কুইজ প্রতিযোগিতা। এতে পুরস্কার জিতে নেন ফিহির হোসাইন ও মোঃ সাইফুল ইসলাম। পুরস্কারগুলোর সৌজন্যে ছিল নারায়ণগঞ্জের ফ্যাশন হাউজ নকশা ও ই-লিংকসের সম্মানিত ব্রোঞ্জ ম্যানেজার মাওলানা শরীফুজ্জামান জসীম।

ট্রেনের টিকিটপ্রাপ্তিতে সহযোগিতা করেন বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকা স্টেশন ম্যানেজার এম এ জিন্নাহ। প্রিয়জনের পক্ষ থেকে তাকে অনেক ধন্যবাদ।


লিখেছেনঃ ফিহির হোসাইন



সুন্দরবন ভ্রমণের সময় এটা নয়। কিন্তু আমাদের উদ্যোক্তা মোস্তফা ভাই খুব বিপ্লবী কিসিমের মানুষ। অন্তত সুন্দরবনের ক্ষেত্রে। তিনি বললেন, সুন্দরবনে যাওয়ার আবার সময়-অসময় কি?

একাই দৌড়ঝাঁপ করে দিন পনেরোর মধ্যে তিনি সুন্দরবন যাওয়ার সব আয়োজন শেষ করে ফেললেন।

বিশ জনের দলটা রওনা হয়ে গেলো সুন্দরবনের দিকে। মাঝারি মাপের একটা জাহাজে। আমাদের অধিকাংশের ধারণা ছিল সদরঘাট অথবা বুড়িগঙ্গার কোনো এক জায়গা থেকে আমরা উঠবো। কিন্তু শেষ দিকে জানা গেলো আমাদের সবাইকে উঠতে হবে ডেমরা ঘাট থেকে। আমাদের ট্যুরের পুরো দায়িত্ব ’দি গাইড ট্যুরস লিঃ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ঘাড়ে।

নির্দিষ্ট দিন দুপুরে আমরা একত্রিত হলাম হোটেল শেরাটনের গাইড ট্যুর অফিসে। সেখানে তাদের গাড়ি করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো ডেমরা ঘাটে। গাইড ট্যুরের জাহাজটা ঠিক ডেমরা ঘাটে থাকে না। থাকে একটু দূরে। অবশেষে স্পিডবোটে করে আমাদের তোলা হলো জাহাজে।

 

তখন প্রায় শেষ বিকাল। আমাদের জাহাজ রওনা দিলো সুন্দরবনের উদ্দেশে। ভ্রমণে পুরুষদের তুলনায় নারীদের উৎসাহ বোধহয় বেশি থাকে। দলের নারী সদস্যরা সবাই জাহাজের রেলিং ধরে উপভোগ করতে লাগলো বাতাস ও নৌযাত্রা। পুরুষরা এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করে জাহাজের অন্যতম আকর্ষণ তাস খেলার দিকে মোড় নিলো। কেবিনে কেবিনে চলছে কার্ডস খেলা। সময়ের সাথে সাথে এক সময় প্রিয়ার কালো চোখও ঘোলাটে হয়ে যায়। নারী সদস্যরাই বা আর কতোক্ষণ উপভোগ করবে বাতাস কিংবা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। তাছাড়া রাতের বেলা প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে চাওয়াটা বুদ্ধিমানের পরিচয়ও নয়। তাই রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারাও ভিড় বাড়াতে থাকে তাসের আসরের আশপাশে, দুএকজন কার্ডস খেলা জানেও। কেউ আহলাদ করে বলে ‘শিখিয়ে দেন, তাহলেই পারবো’।

কেবল খেলতে জানলেই তো চলবে না, দক্ষ খেলুড়ে হতে হবে। বাধ্য হয়ে মেয়েদের হাতে এক সেট কার্ড তুলে দিয়ে বলা হলো- যাওগা, তোমরা তোমাদের মতো করে খেলো।

আমরা সবাই কেবিনে খেলায় ব্যস্ত। জাহাজ যে থেমে আছে বুঝতেই পারিনি। পরে জানা গেলো, সারারাত তারা জাহাজ চালায় না। রাত গভীর হওয়ার আগেই তারা জাহাজ নোঙর করে ঘুমিয়ে পড়ে। কাকভোরে আবারো রওনা দেয়। রাত পর্যন্ত একটানা চলতে থাকে। নৌপথে কিছু কিছু পয়েন্ট আছে যেখানে রাতে জাহাজ নোঙর করা হয়। পুলিশ ফাঁড়ি এবং লোকালয়ের আশেপাশে। প্রতিরাতে একাধিক জাহাজ এই পয়েন্টগুলোতে নোঙর করে দম নেয়। আমাদের জাহাজ প্রথম নোঙর করে চাঁদপুরের কাছাকাছি কোনো এলাকায়। ভোরে আবার চলতে শুরু করে।

সারাদিন জাহাজ চলে বিকালের দিকে পৌঁছে গেলো খুলনার কাছাকাছি। সিগারেট এবং চায়ের জন্য চিনি কিনতে হবে। জাহাজ নোঙর করলো দূরে গ্রাম্য হাটের মতো একটা বাজার দেখা যাচ্ছে সেখানে। কার কি লাগবে সেই তালিকা নিয়ে। স্পিডবোটে করে আমাদের কয়েকজন রওনা হলো বাজারে। ভ্রমণ দলের একমাত্র সাদা চামড়া বিদেশী হ্যারি বললো সে খুব ভালো সাঁতার জানে। আমরা মুখ টিপে হাসি- ব্যাটা তোমার দেশে তো নদীই নাই, ভালো সাঁতার জানবে কিভাবে? আমাদের নারী সদস্যরা হ্যারিকে উসকে দিলো- হ্যারি তুমি নিশ্চয়ই ভালো ডাইভও দিতে জানো। হ্যারি বলে- নিশ্চয়ই! তাহলে তুমি এই দোতলা থেকে দাও না একটা ডাইভ। আমরা দেখি। হ্যারি সামান্য দোনোমনো করলে মেয়েরা বোঝালো, ওই যে দেখো আমাদের স্পিডবোট এখনো বাজারে পৌঁছায়নি। বাজারে যাবে, সবার জন্য কেনাকাটা করবে। তারপর ফিরবে। ততোক্ষণে তুমি সাঁতার দিয়ে কাপড় পাল্টে আবারও মি. হ্যারি হয়ে যেতে পারবে। হ্যারির চেহারায় দোটানা ভাব। এতো স্রোত সামলাতে পারবে তো! কিন্তু মেয়েদের প্রস্তাবে রাজি না হলে পৌরুষ হারানোর ভয়। আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে হ্যারি তার টি-শার্টটি খুলে ফেলে। পরনে শুধুই শর্টস। দোতলার রেলিং পেরিয়ে জাহাজের প্রান্তে দাঁড়ালো হ্যারি। ডাইভ দিলো। সেটা কোনো ডাইভ নয়। মাথা নিচু করে পানিতে পড়া। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাথাটা তার নিচু থাকলো না। বুক, পেট, মাথা, পা সহ এক সঙ্গে থপ্‌ পানিতে পড়লো হ্যারি। ডুবে গেলো পানিতে। পনেরো-বিশ সেকেন্ড পার হয়ে যায়, হ্যারিকে দেখা যায় না। খুবই টেনশনে পড়ে গেলাম। ডাইভ দিতে গিয়ে নিশ্চয়ই পানিতে আঘাত পেয়েছে। জাহাজের ক্রুদের বলবো কিনা- এমন সময় হ্যারি ভেসে উঠলো হাসিমুখে। মেয়েদের কালোমুখগুলো উজ্জ্বল হতে থাকলো। আমি কেবিনে গেলাম। একটু বিশ্রাম নেয়া দরকার। শুধু খেলা আর আড্ডাবাজির ওপর আছি। মিনিট পাঁচেক পরেই দরজায় নক। তোজো ভাই, দ্রুত আসেন হ্যারিকে পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া যাচ্ছে না মানে? ওকে সাঁতরিয়ে জাহাজের দিকে আসতে দেখলাম। স্রোতের কারণে আসতে পারেনি। ওই যে দেখেন, স্রোত ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। চেষ্টা করেও হ্যারিকে দেখতে পেলাম না। সবার হৈ-চৈ শুনে ক্রুরা এসে তিন কয়েল রশির সঙ্গে টিউব বেঁধে ছেড়ে দিলো। টিউব এগিয়ে যাচ্ছে হ্যারির দিকে, হ্যারি পিছিয়ে যাচ্ছে স্রোতের টানে। আমরা কিছু দেখছি না কিন্তু যারা আগে থেকে হ্যারিকে দেখেছে তারা বলছে- ও-ই যে হ্যারি। স্রোতের মধ্যের বিন্দুটা।

স্পিডবোটটাও নেই। গেছে বাজারে। থাকলে নিমেষে হ্যারিকে উদ্ধার করা যেতো। আমাদের যখন দমব অবস্থা, ঠিক তখন একটা যাত্রবাহী ট্রলার আসছিল হ্যারির দিকে। হ্যারিকে দেখে ট্রলার তার কাছে গেলো, তাকে টেনে তুললো, আমরা দেখছি। জাহাজে নিয়ে এলো হ্যারিকে। ট্রলারের যাত্রীরা একেকজন একক কথা বলছিলো। ওরা যতোক্ষণ রইলো আমরা সবাই সমানে তাদের ধন্যবাদ জানাতে লাগলাম। এমন সময় দলনেতা মোস্তফা ভাই স্পিডবোট নিয়ে এলেন কি হয়েছে? এখানে এতো ভিড় কিসের?

আমাদের জাহাজ রওনা দিল। রাত দশটার দিকে আমরা পৌঁছলাম সুন্দরবনের প্রান্তে। শরণখোলা ফরেস্ট রেঞ্জ এলাকায়। জাহাজ নোঙর করা হলো। আমাদের সেখানে অনুমতি নিতে হলো সুন্দরবনে যাওয়ার। শোনা গেলো ইদানীং সেখানে ডাকাতের উৎপাত ঘটে। আর ডাকাত না থাকলেও আছে বাঘের ভয়। ফলে দু’জন গানম্যান ভাড়া করা হলো। একজনের শরীর এতোই পেশি বহুল যে তাকেই ডাকাত মনে হয়। তার হাতে বন্দুকটা খুবই বেমানান লাগছিল। খেলনা খেলনা মনে হচ্ছিল। বন্দুকের ভয়ে নয়, পেশির ভয়েই বাঘের আসার কথা নয় তার আশেপাশে। পরদিন খুব সকালে জাহাজ ছাড়লো। আমাদের লক্ষ্য কটকা অভয়ারণ্য। ঘন্টা চারেকের মধ্যে পৌঁছে যাওয়ার কথা কটকায়।

দুদিক ঘন বন। সেই বন চিরে বয়ে গেছে নদী। সেই নদী চিরে ছুটে যাচ্ছে আমাদের জাহাজ। আমাদের দলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো। কেউ বলছে এতোক্ষণ ধরে বনের মধ্য দিয়ে ছুটছি একটা ইঁদুরও দেখলাম না। কারো মন খারাপ, সে ভেবেছিল এখানকার পানি হবে খুবই স্বচ্ছ। কিন্তু পানি ভয়াবহ ঘোলা। কেউ ভেবেছিল বন মানে টারজানের বন; যেখানে কলা-কাঁঠাল জাতীয় বন্য ফলমূল থাকবে, থাকবে ফুল। তার আশাভঙ্গ হয়েছে। এ তো শুধুই জঙ্গল! কেউ কেউ সুন্দরবনের ‘সুন্দরী’ গাছ দেখার জন্য উদগ্রীব। অথচ কেউই বলতে পারছে না কোনটা সুন্দরী গাছ। একেকজন এককটাকে বলছে। কেবল নদীর ধারে গোলপাতাটাকে শনাক্ত করা গেলো। কি আর করা, সব উৎসাহ গোলপাতাকে ঘিরেই শুরু হয়ে গেলো। এ ওকে বলতে লাগলো, এই যে নদীর ধারে দেখছিস না লম্বা লম্বা পাতা ওগুলোর নাম গোলপাতা। হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি জানি। কিন্তু তুই বলতো, কেওড়া গাছ কোনটা? কেওড়া গাছ না চিনতে পারার কারণে সে হয়তো উল্টো বলে বসছে- আরে গাধা সুন্দরবনে এসে কেউ বেওড়া গাছ খোঁজে নাকি? সুন্দরবন বিখ্যাত সুন্দরী গাছের জন্য। বলতো, সুন্দরী গাছ কোনটা?

এর মধ্যে আমাদের ডাক পড়লো সবার। উদ্দেশ্য- সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শোনানো। আমাদের গাইড শোনাচ্ছেন। সুন্দরবন এলেই সুন্দরবন দেখা যায় না। এখানে নিজের মনটাকে বনের সঙ্গে একাত্ম করতে হয়। তা না হলে বনের ভাষা বোঝা যায়! আপনারা কেউ সিগারেটের টুকরা, চকলেট-চুইংগামের খোসা নদীতে ফেলবেন না। পরিবেশ দূষিত হয়। কেউ উচ্চস্বরে কথা বলবেন না। প্রাণীদের ডিসটার্ব করা হয়। ইত্যাদি, ইত্যাদি।

এরই মধ্যে আমাদের জাহাজ কটকা অভয়ারণ্য এলাকায় নোঙর করলো। অধিকাংশের মধ্যে দেখা গেলো একই সঙ্গে বিপরীত প্রতিক্রিয়া। বনে ঢোকার আগে কারো কোনো ভয়-ডর দেখা যায়নি। কিন্তু বনে ঢোকার পর অধিকাংশের মধ্যে চাপা বাঘের ভয় দেখা গেলো। কিন্তু পাশাপাশি সবাই বাঘ দেখতেও চায়।

খুব চুপচাপ এবং এক ধরনের ভাবগম্ভীর পরিবেশের ভেতর দিয়ে আমরা রওনা হলাম কটকা পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের দিকে। গাইড বাচ্চু ভাইয়ের মতে, ভাগ্য ভালো থাকলে এই টাওয়ার থেকে বাঘ দেখা সম্ভব।

দলের অনেকে বিশেষত মেয়েরা বাঘের ভয়ে ভীত। কিন্তু খামাখা বাঘের ভয় পেয়ে অসুস্থ হওয়ার তেমন মানে নাই। কারণ, বাঘ মাত্রই মানুষ খায়, আমাদের মধ্যে প্রচলিত এই ধারণা ভিত্তিহীন।

বিশেষ কিছু পরিস্থিতিতে বাঘ মানুষ খেকো হয়। এই ধরনের বাঘকে বলে ‘ম্যান-ইটার’ বা ‘ম্যানিটার’। খুব বাস্তব ধরনের তিনটা কারণে সাধারণ বাঘ ‘ম্যানিটার’ হয়।

এক. যে বাঘটা বনের যে অঞ্চলে থাকে সেই অঞ্চলে যদি তার খাদ্য স্বল্পতা থাকে।

দুই. যদি বাঘটার বয়স বেশি হয় এবং বার্ধক্যজনিত কারণে ক্ষিপ্র প্রাণী হরিণ-বানর এসব ধরার শারীরিক ক্ষমতা না থাকে।

তিন. যদি বাঘটা আহত হয়ে থাকে।

আমাদের গাইড আমাদের আশ্বস্ত করলেন, এই অঞ্চলে ম্যানিটার বাঘ নাই।

উঁচু পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে উঠে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। পাশেই বঙ্গোপসাগর। টানা গর্জন সমুদ্রের। আমাদের অভ্যস্ত জীবনের সম্পূর্ণ উল্টো পরিবেশ। এই পৃথিবী, এই বিশাল প্রকৃতি; সৃষ্টি সম্পর্কে অন্যভাবে ভাবতে শেখায়।

অনেকক্ষণ টাওয়ারে বসেও বাঘের দেখা মেলে না। আমরা বনের ভিতর ঢুকে যাই। অদ্ভূত নিস্তব্ধতা। বন পেরিয়ে পৌঁছে যাই সাগরপাড়ে। বঙ্গোপসাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ছে সুন্দরবনের পায়ে। সুন্দরবনকে হাত দিয়ে ছুঁয়ে আমরা ফিরে আসি জাহাজে। তখন ভাটা শুরু হয়েছে। দ্রুত পানি কমে যাচ্ছে। সেখানে নেমে আসছে হরিণের দল। পানি খাচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে। একেবারেই নিরাপদ তারা। মানুষ নিজেদের জন্য না পারুক, পশু-পাখিদের জন্য যে অভয়ারণ্য তৈরি করতে পেরেছে এও কি কম! কি সুন্দর আমরা গাছপালা-পশু পাখি দেখতে গিয়েছি এতোদূর, ওরা কি কখনো আমাদের দেখতে আসবে?

সুন্দরবনে প্যাকেজ ট্যুর

অনেকেই বলেন মনোহরণ সুন্দরবন, এর দেখার শেষ নেই। এই মনোহরণ বন দেখার রহস্যময় হাতছানিতে পৃথিবীর দূর-দূরান্ত থেকে ট্যুরিস্টরা আসেন। অথচ এদেশের মানুষেরই সুন্দরবন দেখা হয়ে ওঠে না। চাইলেই কিন্তু আপনি বা আপনারা সুন্দরবন দেখে আসতে পারেন, তার জন্য দরকার একটু সময় খুঁজে বেরিয়ে পড়া। এদেশে এখন সুন্দরবন বেড়ানোর ব্যবস্থা নিয়ে ভ্রমণ বিলাসীদের জন্য বেশ কয়েকটি সংস্থা নানাধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অপেক্ষা করছে। আপনার থাকা, খাওয়া থেকে শুরু করে নানাধরনের প্রয়োজন মেটাতে তারা সদাতৎপর।



লিখেছেনঃ আলি ফিদা

খুলনা ঘাট থেকে লঞ্চ ছাড়তেই মিনিট দশেকের জন্য আলী ভাই হাওয়া। খানিক বাদেই তাঁকে পেলাম লঞ্চের বারান্দায় একদম ভিন্ন পোশাকে, শিকারির পোশাক, যেন জিম করবেট। শুধু মাথার ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দলের লোগো লাগানো মেরুন রঙের টুপিটাই যা একটু বেখাপ্পা। দূর থেকে জঙ্গল দেখতে তার কাছে বায়নোকুলারটা চাইতেই আমাকে সে কী ভর্ৎসনা! ‘বুঝলা, বন্দুক ছাড়া যেমন যুদ্ধে যাওয়া ঠিক না, তেমনি বায়নোকুলার ছাড়া জঙ্গলে যাওয়া ঠিক না। কী যে কর না! আমাকে দেখো, পায়ের বুট থেকে শুরু করে চোখে সানগ্লাস, ক্যামেরা, বায়নোকুলার, টুপি-কী নাই?’

রাতে এক কেবিনে জায়গা হলো দুজনের। ‘মিলন, তোমার কাছে কি এক্সট্রা লুঙ্গি আছে? আমি আবার রাতে লুঙ্গি ছাড়া ঘুমাতে পারি না।’ মনে হলো জিজ্ঞেস করি, আলী ভাই, এত কিছু আনলেন, অথচ যেইটা ছাড়া ঘুমাইতে পারেন না, সেই জিনিসই আনলেন না? সাহস পেলাম না সে কথা বলতে। সুন্দরবন দেখতে এসে আলী ভাইকে খেপানো ঠিক হবে না। আমার কাছে নেই জেনে কয়েক সেকেন্ড কী যেন ভাবলেন, তারপর বিছানার চাদরটাকেই কোমরে জড়িয়ে নিতে নিতে বলে চলেছেন, ‘বুঝলা, লুঙ্গির মতো আরামের আর কিছু হয় না।’ বুঝেছি বলেই দোতলা বিছানায় চোখ বুজে ফেললাম তাড়াতাড়ি।

আলী ভাইয়ের মতো পর্যটকেরও যদি এমন ভুল হয়, তবে আমরা আর কী দোষ করলাম! আমাদেরও হরহামেশা এমনটা হয়। সব জিনিসই সঙ্গে নিলাম, কেবল প্রয়োজনেরটা ছাড়া। আবার অনেকে প্রয়োজনেরটা তো সঙ্গে নেয়ই, অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে ব্যাগ ভরে। আমার কথাই বলি, জীবনে প্রথম ভারতে গিয়েছিলাম তিন জোড়া জুতা নিয়ে। এর মধ্যে এক জোড়া হাই হিল সু। সে কী কষ্ট! শেষে সহযাত্রী বন্ধুকে কেডসের চেয়ে জুতাতেই বেশি ্নার্ট লাগে-এই তত্ত্ব গিলিয়ে তার কেডস দিয়ে সেবার ১৫ দিন পার করে দিলাম।

যাদের এমন বন্ধুভাগ্য আছে তাদের কথা বাদ। বাকিরা কোথাও বেড়াতে যাওয়ার আগে বসে যায় পরিকল্পনায়। কবে যাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে, আর থাকবেই বা কত দিন। যাচ্ছি বলে বেরিয়ে পড়া লোকের এতসব না ভাবলেও চলবে। তবে যারা সপরিবারে বেড়াতে যাবে, তাদের জন্য পরিকল্পনাই বেশ জরুরি। প্রথমেই আসুন যাত্রার দিনক্ষণ ঠিক করি। আমাদের দেশে পর্যটন মৌসুমটা মোটামুটি চার মাসের অর্থাৎ নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি। এর আগে-পরে এক মাস করে ধরে টেনেটুনে ছয় মাস।

এর মধ্যে দুই ঈদ আর ডিসেম্বর মাসটা বেশ জমজমাট। ডিসেম্বর মাসে অধিকাংশ স্কুলেই ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে যায় বলে বাচ্চাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ার জন্য ডিসেম্বরই সবচেয়ে ভালো। তবে এর আগে-পরে নিজেদের আর বাচ্চাদের ছুটি মিলিয়ে একটা দিন ঠিক করে ফেলুন।

এরপর আসুন, ঠিক করি কোথায় যাবেন। স্থান নির্বাচনের আগে পরিবারের সবার সঙ্গে আলাপ করে নিন। নয়তো বিপদটা আসবে অন্য দিক দিয়ে। যেমন, আপনার স্ত্রী-সন্তান খানিকটা নিরিবিলি এলাকায় বেড়াতে ভালোবাসে। অথচ আপনি তাদের নিয়ে গেলেন পিক সিজনে কক্সবাজারে। খাবার হোটেলে লাইন, সৈকত আর শহরজুড়ে মানুষজনের গিজগিজে ভিড়। ব্যস, আর যায় কোথায়! বেড়াতে এসে স্ত্রী-সন্তানের গোমড়া মুখ দেখতে কি আর ভালো লাগবে? আবার অন্য দিকটাও আছে। ধরুন, পরিবারের সদস্যরা একটু হইচই, মানুষজনের মধ্যে থাকতে ভালোবাসে, অথচ আপনি নিয়ে গেলেন বান্দরবান বা সেন্ট মার্টিন দ্বীপে।

একবার বন্ধুদের নিয়ে বান্দরবান ঘুরে সেন্ট মার্টিন গেলাম। এক বন্ধু তো ঘোষণা দিয়ে দিল যে আমার সঙ্গে আর বেড়াতে আসবে না। আমি নাকি বান্দরবানে দেখিয়েছি শুধু পাহাড় আর পাহাড়, সেন্ট মার্টিনে দেখাচ্ছি কেবল পানি আর পানি। এত পানি দেখার কী আছে? সেই গল্পটার মতো, পাহাড় বেড়িয়ে আসা এক লোককে তার বন্ধু জিজ্ঞেস করল, ‘দোস্ত, প্রকৃতি কেমন দেখলা?’ উত্তর, ‘চারদিকে খালি পাহাড় আর পাহাড়, প্রকৃতি দেখুম কেমনে?’ বুঝুন অবস্থা।

বেড়ানোর জায়গা ঠিক হয়ে গেল। এবার বসুন বাজেট নিয়ে, মানে টাকা-পয়সার হিসাব নিয়ে। কোথায় যাবেন, কতজন যাবেন, কেমন হোটেলে থাকবেন-খুঁটিনাটি সবকিছুই মাথায় রাখতে হবে। মনে রাখবেন, বেড়াতে গিয়ে এক গ্লাস বিশুদ্ধ পানি খেতেও গাঁটের পয়সা গুনতে হবে। একেকবার বেড়িয়ে এসে ঘরে খেতে বসলেই মনের মধ্যে হিসাব চলে আসে। ভাত ২০ টাকা। মাংস ৭০ টাকা, ডাল ১০ টাকা ইত্যাদি। ডুবো ডালে ভাত খাওয়ার বিলাসিতাটা এখন ঘরেই করি। সে যা-ই হোক, বেড়ানোটা যেহেতু খরচের ব্যাপার, একটা কাজ করা যেতে পারে। পরিবারের সবাই মিলে একটা বেড়ানোর ব্যাংক করতে পারেন। প্রতিজন সদস্য প্রতিদিন টাকা জমাবেন। ভাবুন, কেবল আপনিই যদি প্রতিদিন ১০ টাকা করে জমান, তবে বছর শেষে আপনার জমার পরিমাণ হবে কম করে হলেও তিন হাজার ৬০০ টাকা। আর এই টাকা দিয়ে বাংলাদেশের যেকোনো স্থানে চার-পাঁচ দিন বেড়িয়ে আসতে পারবেন তার গ্যারান্টি দিচ্ছি। স্কুলপড়ুয়া সন্তানদেরও উদ্বুদ্ধ করুন এ কাজে। দেখবেন, কেমন উৎসাহ নিয়ে নেমে পড়ে। আর নিজের টাকায় ঘুরে বেড়ানোর মজাই আলাদা। অনেকে দল বেঁধে বেড়াতে ভালোবাসে। এতে সুবিধা যেমন আছে, তেমনি অসুবিধাও আছে। সুবিধা হলো, এতে বেড়ানোর খরচ বেশ খানিকটা কমে যায়। শেয়ার করে থাকতে পারলে হোটেল খরচ বাঁচানো যায়। গাড়ি ভাড়া আর খাবার খরচ তো আছেই। আর দলের সবাই যদি মোটামুটি সমমনা না হয়, তবেই বিপত্তি।

সেই সুন্দরবন ভ্রমণেরই এক সন্ধ্যায় লঞ্চের টিভি রুমে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ওপর ডিসকভারি চ্যানেলের একটা প্রোগ্রাম দেখছিলাম। পাশে বসা সহযাত্রী কানে কানে বললেন, ‘সুন্দরবনের বাঘগুলো মেরে ফেলা উচিত। দেখেন না, কেমন ধরে ধরে হরিণ মেরে শেষ করে দিচ্ছে?’ বাকি তিন দিন লোকটাকে এড়িয়ে চলেছিলাম। তাই সঙ্গী নির্বাচনে কৌশলী হোন।

মোশতাক আহমেদ, টিপু সুলতান আর আফজাল হোসেন-এই তিনজন কাজ করেন এক বেসরকারি ব্যাংকে। মাসখানেকের পরিকল্পনা শেষে তিন পরিবারের মোট ১৩ জনের দল নিয়ে পৌঁছালেন কলকাতায়, রোজার ঈদের পরপরই। বিপত্তি বাধল তার পর। একে দুর্গাপূজা, তার ওপর ১৩ জনের বিশাল দল। হোটেলে রুম পাওয়া গেলেও কিছুতেই জোগাড় করতে পারলেন না দিল্লি যাওয়ার ট্রেনের টিকিট। এক ট্রেনে এক কম্পার্টমেন্টে এতগুলো টিকিট অতিরিক্ত টাকা দিয়ে পেলেন না। প্লেনের টিকিট কাটতে গিয়েও একই ব্যাপার। খাবার হোটেলে ১৩টি খালি চেয়ার পাওয়া, বেড়াতে গিয়ে তিনটি খালি ট্যাক্সি, নিক্কো পার্কের ১৩টি টিকিট-সব মিলিয়ে ১৩ সংখ্যাটি খুব একটা সুখকর ছিল না দলটির কাছে। শেষে দিল্লি, জয়পুর, আগ্রা বেড়ানোর পরিকল্পনা বাদ দিয়ে কলকাতার নিউমার্কেট, গড়িয়াহাটে শপিং করে ফিরে আসেন তাঁরা। তাই দল বেঁধে গেলেও তা চার-পাঁচের মধ্যে থাকলেই ভালো। তবে কোনো ট্যুরিজম প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্যাকেজ ট্যুরে গেলে ভিন্ন কথা।

চলুন, শুরু করে দিই বেড়ানোর আয়োজন পরিবারের সবাইকে নিয়ে। দেশে বেড়ে উঠুক পারিবারিক ভ্রমণের সংস্কৃতি। আর যদি হঠাৎ করেই চলে আসে কোথাও বেড়ানোর সুযোগ, হাতছাড়া করবেন না মোটেও। আরে এতকিছু ভেবে কি আর ঘুরতে যাওয়া যায়? ‘যাচ্ছি’ বলে বেড়িয়ে পড়ুন তো, গোল্লায় যাক উপদেশমালা।



লিখেছেনঃ ফখরুল আবেদীন মিলন

১লা ডিসেম্বর সোমবার বিকেল ৬টায় আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম এর ক্যামপাস্ থেকে আমরা ৫০ জন ছাত্র শতাব্দী পরিবহনের গাড়ীতে রওনা দিলাম মংলা বন্দরের উদ্দেশে। চট্টগ্রাম হতে ঢাকা হয়ে মাওয়া ফেরীঘাট পার হয়ে দীর্ঘ ১৫ঘন্টা লাগলো মংলা বন্দরে পৌছাতে।
মাওয়া ফেরীঘাট পার হতেই লাগলো দীর্ঘ ৪ঘন্টা। পদ্মা নদীর এপার থেকে ওপারে নেওয়ার ফেরীতে অবশ্য ৪ঘন্টা সময় কাটাতে তেমন কষ্ট হয়নি।
কারণ একেতো সুন্দরবন যাওয়ার উত্তেজনা,তার উপর বিশাল ৫তলা ফেরী। আর পদ্মার সৌন্দর্য্যতো আছেই।
ফেরী যখন পদ্মা নদীর মাঝামাঝি তখন কেবল ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটছিল।সে এক অসাধারণ দৃশ্য।২রা ডিসেম্বর ৯টায় আমরা মংলা বন্দরে পৌছালাম।ওখান থেকেই মূলত আমাদের মূল ভ্রমন শুরু।
তবে মংলা বন্দরের দূরাবস্থা দেখে খারাপ লাগলো খুব।আগে থেকেই ঠিক করে রাখা রেডসান-১ লঞ্চ এ করে আমরা রওনা দিলাম সুন্দরবন এর দিকে।
ঢাংমারী ফরেষ্ট ষ্টেশন থেকে সুন্দরবন ঢুকার মুখেই নিতে হলো প্রয়োজনীয় অনুমতি এবং সুন্দরবন ঘোরার জন্য গানম্যান।
তারপর আমরা রওনা দিলাম ভৌগলিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হিরইন পয়েন এর দিকে।মংলা বন্দর থেকে হিরইন পয়েন এ যেতে লাগলো প্রায় ৫ঘন্টা।
এই ৫ঘন্টা পশুর নদীর দু পাশের সুন্দরবনের দৃশ্য ও সবাই মিলে গল্প করে কাটালাম।মাঝে দুপুরের খাওয়াটা ও শেষ করে নিলাম লঞ্চ এর ডাইনিং এ।
৪টার দিকে আমরা হিরইন পয়েন এ পৌছালাম।
চট্টগ্রাম থেকে সুন্দরবনের হিরইন পয়েন দীর্ঘ ২০-২১ ঘন্টার ভ্রমন ।
দীর্ঘ এই ভ্রমন শেষে লঞ্চ যখন হিরইন পয়েন ঘাটে ভিড়লো তখন দিনের আলো প্রায় শেষের পথে।নিরাপত্তা জনিত কারণে কাউকে লঞ্চ থেকে নামার অনুমতি দিলেন না শিক্ষকরা। দু পাশে সুন্দরবন আর আমরা নদীর মাঝে,সূর্যের পড়ন্ত আলোয় চারদিকে এক মায়াবী পরিবেশ।
সবাই তখন নিশ্চুপ বসে বসে কেবল উপভোগ করছে প্রকৃতি।
সূর্যের আলো পশ্চিম আকাশে মিলিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই লঞ্চের বৈদ্যতিক আলো জলে উঠলো আর সাথে সাথেই
সবাই ছুঠলো যার যার নির্ধারিত কেবিন এ।কারণ আর কিছুই নই,সবাই মোবাইল চার্জ দিয়ে নিচ্ছিলো।
যদি ও হিরইন পয়েন এ আসার অনেক আগে থেকেই কোন মোবাইলেই নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছিলোনা।
রাতের আধারে বাইরের কিছুই যেহেতু স্পষ্ট নয়,তাই ঐ দিন লঞ্চের ভিতরে সবাই গানবাজনা আর গল্প করেই কাটিয়ে দিলাম।
স্যারেরাও আমাদের সাথে অংশ নিলেন।রাত ৯টার দিকে আমরা রাতের খাবার খেয়ে সবাইকে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর সুযোগ করে দিলাম যাতে পরদিন সূর্যদোয় মিস্ না হয়।তাছাড়া সবাই দীর্ঘ ভ্রমনজনিত ক্লান্তও ছিল।
৩রা ডিসেম্বর বুধবার, ভোর ৪.৩০ এ ঘুম ভাঙ্গলো।উঠেই কেবিন থেকে বের হয়ে দেখি সবাই প্রায় উঠে গেছে।
আশেপাশে তাকিয়ে দেখি চারপাশ কুয়াশার চাদরে ঢাকা।তারপর মুখহাত ধুয়ে সবাই যখন তৈরী হয়ে এলো ততোক্ষণে সূর্য পূব আকাশে উকিঁ দেয়া শুরু করছে।
লঞ্চের সাথে থাকা ইন্জ্ঞিন চালিত নৌকায় করে আমরা ৫০ জন রওনা দিলাম ভোর রাতের সুন্দরবন দেখার উদ্দেশ্যে।
দুই পাশে ঘন বন,গোলপাতা,সুন্দরী সহ আরও অনেক নাম না জানা গাছগাছালি দেখতে দেখতে এগুচ্ছে আমাদের নৌকা।দুই তীরে এবং গাছের ডালে অলস বসে আছে বিভিন্ন জাতের বক ও নাম না জানা পাখিরা।নানান রঙের,নানান সৌন্দর্যের মাছরাঙাগুলোই কেবল ব্যস্ত সময় পার করছিল মাছ শিকার করে।
নদীর দুই পাড়ে স্থানীয় জেলেরা ব্যস্ত ছিল তাদের লাগানো জাল থেকে মাছ ছড়ানোতে।আমরা সবাই তখন ব্যস্ত প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য্য অবলোকন করায়।
এমন সময় হঠাৎ হামিদ স্যার এর চিৎকারে আমরা অবাক হয়!
ব্যাপার কি?
আর কিছুই না,গাছের ফাঁকে সুন্দরবনের এক মায়াবী হরিণ।আমরা সবাই অবাক চোখে হরিণটাকে দেখছি,ঠিক তেমনি হরিণটিও অবাক হয়ে আমাদের দেখছে!
তারপর আবার চিৎকার…
আরও হরিণ…
অসাধারণ সেই অনুভূতি।
আমাদের নেওয়া ডিজিটাল ক্যামরাগুলোর তথ্য ভান্ডার দ্রুত সমৃদ্ধ হচ্ছিল হরিণ,পাখি এবং নাম না জানা অচেনা সব গাছের ছবি তুলে ও ভিড়িও করে।
এইভাবে কখন যে সূর্য পূব আকাশে সম্পূর্ণ উঠে গেছে খেয়ালি করেনি কেউ।
এরপর আমরা ইন্জ্ঞিন নৌকায় গেলাম হিরইন পয়েন এর জেঠিতে।উদ্দেশ্য হিরইন পয়েন ঘুরে দেখা।হিরইন পয়েন এ ঢোকার মুখেই ছিল বিশ্ব ঐতিয্য ফলক।আগে-পিছে ২জন নিরাপত্তা রক্ষী নিয়ে আমাদের পুরো দলটাই প্রথমবারের মত সুন্দরবনের ভিতরে প্রবেশ করলো।
অবশ্য হিরইন পয়েন এ আমরা তেমন কোন প্রাণীই দেখিনি।তবে গানম্যান যখন আমাদের ডেকে বাঘ মামার পায়ের ছাপ দেখালো তখন যে সবার মনে অজানা ভয় এসে ভর করলো তা সবার চোখেমুখেই ভেসে উঠলো।কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর আমরা উঠলাম হিরইন পয়েন এর পর্যবেক্ষণ টাওয়ার এ।
এই টাওয়ারটির বর্তমান অবস্থা খুবই নাজুক।৫ তলা বিশিষ্ট এই টাওয়ার এ ৫ জনের বেশী একসাথে ওঠা নিষেধ।
টাওয়ার এর উপর থেকে তেমন কিছু দেখাও যায়নি।
হিরইন পয়েন দেখে লঞ্চ এ ফিরে এসেই সবাই সকালের নাস্তা শেষ করলো।তারপর আমাদের লঞ্চের ক্যাপ্টেন ঘোষণা দিলেন,আমরা হিরইন পয়েন থেকে লঞ্চ ছেড়ে দুবলার চরের উদ্দেশ্যে রওনা করছি।এভাবেই শেষ হলো আমাদের হিরইন পয়েন এর অভিযান।
লঞ্চ এখন দুবলার চরের পথে…
বাতাসে শুটকির গন্ধ পেয়েই বুঝলাম আমরা দুবলার চরে পৌছে গেছি।দুবলার চরে পৌছাঁলাম তখন সকাল ১০.৩০।
সবাই নামলাম।স্যারেরা সময় বেধে দিলেন আধা ঘন্টা।কারণ আমাদের পরের গন্তব্য কটকায় পৌছাতে হবে দ্রুত।
দুবলার চরে নেমেই ছুটে গেলাম শুটকি পরিদর্শনে। নানা জাতের নানা ধরনের শুটকি শুকানো হচ্ছে।সবচেয়ে ভালো লাগলো যখন জানলাম,ওখানে কাজ করা মানুষগুলো বেশীর ভাগই চট্টগ্রাম জেলার।নিজেদের জেলার মানুষ পেয়ে তারাও খুব খুশি, এই সুযোগ এ আমরাও কিছুটা কম দামে শুটকি পেয়ে গেলাম তাদের কাছে!অনেকেই শুটকি কিনলাম আমরা।ফাকেঁ ফাকেঁ ছবি তুলছিল সবাই।বেশ কিছু গ্রুপ ছবি তুললাম।আমার ক্যামেরাও থেমে ছিল না।
আরও কিছুক্ষণ এদিক সেদিক হেটেঁ সবাই লঞ্চ এ ফিরে এলাম।এরপর লঞ্চ আবার যাত্রা শুরু করলো কটকার উদ্দেশ্যে।
আবার সেই লঞ্চের একঘেয়ে বটবট আওয়াজ।
কিন্তু নদীর দু পাশের প্রকৃতি সেই একঘেয়েমি দূর করে দেয় নিমেষেই।তার সাথে ছাত্রদের গীটারের টুংটাং আওয়াজ ও দরাজ গলায় গাওয়া গান
ওরে..নীল দরিয়া…
আমায়… দে রে দে… ছাড়িয়…
সে এক দারুন অনুভূতি…
এভাবে কখন যে সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো খেয়ালই করিনি।হঠাৎ লঞ্চের হুইসেল এ সম্বিত ফিরে পেলাম সবাই।বুঝতে পারলাম কটকা চলে এসেছি আমরা।
তাড়াতাড়ি দুপুরের খাবার সেরে নিলাম সবাই।তারপর সবাই দ্রুত তৈরী হয়ে নিলাম কটকা ভ্রমনের জন্য।লঞ্চ ঘাটে ভিড়লে ধীরে ধীরে সবাই নেমে পড়লাম কটকার মূল ভূমিতে।শুরু হলো কটকা অভিযান…
সুন্দরবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর জায়গা কটকা….
লঞ্চ থেকে কটকা ঘাটে নামার পূর্বেই বুঝতে পারলাম কেন কটকা এতো আকর্ষনীয় পর্যটন স্পট।নদীর দু পাশেই ঘন জঙ্গল,তার ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির বানর,পাখি ও হরিণ।আমাদের আসার আওয়াজ পেয়ে তারা লুকাতে থাকে বনের গভীরে।
সবাই নামলাম লঞ্চ থেকে।তারপর স্যারেরা আমাদের ৭টি গ্রুপে ভাগ করে দিলেন,প্রতি গ্রুপে একজন গ্রুপ লিডারও ঠিক করে দিলেন যাতে গ্রুপ লিডার সবার প্রতি নজর রাখতে পারে ।সুন্দরবনের অন্য সব জায়গা থেকে কটকায় অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন এর ব্যাপারে আমাদের আগেই বলে দেওয়া হয়েছিল।অতঃপর কটকা অভিযান শুরু…
সবার সামনে নিরাপত্তা রক্ষী তারপর আমরা এবং সবশেষেও আর একজন নিরাপত্তা রক্ষী,এভাবেই আমরা শুরু করি কটকার অভ্যন্তরে যাত্রা।কটকায় ঢুকার মুখেই পর্যবেক্ষণ টাওয়ার।তাই ৭দলে ভাগ হয়ে আলাদা আলাদা ভাবে টাওয়ার এ উঠলাম।
সে এক অসাধারণ দৃশ্য! চারপাশে সবুজ আর তার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে হরিণের দল।আমরা যে হরিণের এত কাছে তা টাওয়ার এ উঠার আগ পর্যন্ত বুঝতেই পারিনি।ঐ মূহুর্তে সবাইকে প্রকৃতি যেন যাদু করে রেখেছিল তার সৌন্দর্য দিয়ে।
পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থেকে নেমে সবাই বনের গভীরে রওনা দিলাম।
কারও মুখে আওয়াজ নেই…
নিঃশব্দ…
যেন সবাই বাকহারা…
আসলে সবাই চুপ করেছিল হরিণের দল যাতে পালিয়ে না যায় সেজন্য।
হরিণগুলো দলবল সহ ঘুরছিল ।কিন্ত যখনই আমাদের অস্থিত্ব বুঝতে পেলো তখন পালিয়ে গেলো এদিক সেদিক…কিন্তু পালালে কি হবে আমাদের ক্যামেরাগুলোর শক্তিশালী লেন্স ঠিকই তাদের বন্দি করে ফেলেছে ! ততোক্ষণে আমাদের ছাত্রদের দলগুলো মিলেমিশে একাকার।যে যার মত উপভোগ করতে লাগলো এইসব দূর্লভ দৃশ্য।অবশ্য দল ভাঙ্গলেও আমরা সবাই একত্রে ছিলাম সবসময়।তাই স্যারেরাও তেমন বাধাঁ দিলেন না।
এভাবে প্রকৃতি ও হরিণ দেখতে দেখতে কখন যে আমরা গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করেছি বুঝতেই পারিনি। যখন খেয়াল করলাম দেখি দু পাশেই ঘন জঙ্গল। হাজারো গাছ।
একটু ভালোভাবে খেয়াল করতেই দেখলাম শত শত ভাঙ্গাঁ গাছ।
ঘূর্ণিঝড় সিডরের তান্ডব।
সিডর এর ভয়াবহ তান্ডব থেকে পুরো দেশকে রক্ষা করতে সুন্দরবন নিজেকে বিলিয়ে কীভাবে দেশকে রক্ষা করেছে তা নিজে না দেখলে বোঝা অবিশ্বাস্য…!
কিন্তু আশার কথা আবারও জেগে উঠেছে সুন্দরবন । নতুন নতুন গাছগাছালিতে ভরে উঠেছে পুরো সুন্দরবন।যেন এই শীতেই বসন্তের আগমন শোনাচ্ছে সুন্দরবন।সুন্দরবনের এই নতুন জাগরণ সুন্দরবনকে নিয়ে গেছে অন্য এক মাত্রায়।তাই এখনকার সুন্দরবন আগের চেয়ে আরও বেশী সুন্দর,আরও বেশী আকর্ষনীয়।
আমরা এগিয়ে চলছি ঘন জঙ্গলের মধ্যখান দিয়ে….
দুপাশে হাজারো গাছ,নানা প্রজাতির পাখির আওয়াজ এবং গাইডের মুখে বাঘের লোমহর্ষক ঘটনা শুনতে শুনতে আমরা এগুচ্ছি ঘন জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে।
সবাই চুপচাপ,অজানা আতংক মনে, কখন আবার বাঘ মামার শিকার হতে হয় ! হঠাৎ শো শো গর্জন কানে এলো…বাঘ যেন ছুটে আসছে এইদিকে !!
তারপরেও সবাই এগিয়ে যায় সামনের দিকে।
ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠে গর্জন।হঠাৎ করেই পুরো দৃশ্যপঠ বদলে গেল!! সুন্দরবন তার রূপ যেন বদলে ফেললো নিমেষেই।আমাদের সামনে এখন বিশাল জলরাশি।সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে সুন্দরবনের উপর।সে এক অন্যরকম সৌন্দর্য্য,ভাষায় প্রকাশ করার নয়।সাগর জীবনে অনেকবার দেখেছি কিন্তু এমন ভাবে আর কখনো আমার চোখে ধরা পড়েনি।সবাই সাগর দেখে যেন পাগল হয়ে গেল।এতক্ষণের একতাবদ্ধ দলটি ভেঙ্গে,সবাই ছোটাছুটি শুরু করলো।
কেউ গেল পানিতে,কেউ শামুক কুড়াতে,কেউবা গলা ছেড়ে গান ধরলো।
সংবিৎ ফিরে পেলাম যখন গার্ড জানালো ২০০৪ এর এক মর্মান্তিক ঘটনা।
১১ জন ছাত্র-ছাত্রীর পানিতে মৃত্যুবরনের ঘটনা শুনে স্যাররা সবাইকে সাবধান করে দিলেন।
এমন সময় দূর থেকে এক ছাত্রের চিৎকারে পরিবেশ আরও ভীতিকর হয়ে উঠে।কাছে গিয়ে দেখি তরতাজা বাঘের পায়ের ছাপ।একটা-দুটা নয় অনেকগুলো।
গার্ড এগিয়ে এসে এই ছাপ পর্যবেক্ষণ শেষে ঘোষণা করলো এই ছাপ অল্প কিছুক্ষণ আগের।কারণ সমুদ্রের পাড়ের প্রচুর বাতাসে বালিতে এই ছাপ আধা ঘন্টার বেশি থাকেনা।আরও বললো অন্তত দুইটি বাঘ এসেছিল।
আমাদের অবস্থা হলো তখন দেখার মতো।সবাই যেন বাঘ মামার গন্ধ পাচ্ছিলো।
এই বুঝি বাঘ মামা এলো!
কিছুক্ষণ পর গার্ডদের পীড়াপীড়ি ও শেষে স্যারদের নির্দেশে আমরা পূণরায় জঙ্গল পার হয়ে ফিরে এলাম লঞ্চে।শেষ হলো সুন্দরবনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অভিযান।আমরা তৈরী হতে থাকলাম পরের দিনের কারমজল অভিযানের জন্য….
সকালে ঘুম ভাঙ্গলো লঞ্চের ভটভট আওয়াজে…
উঠেই দেখি লঞ্চ করামজলের উদ্দ্যেশে রওনা দিয়েছে ভোর রাতেই।লঞ্চের পিছনে গিয়ে দেখি কটকা এখনো দেখা যাচ্ছে।মনটা খারাপ হয়ে গেল,প্রিয় কটকা থেকে বিদায় নেওয়া হলোনা বলে।করামজল কটকা থেকে দীর্ঘ ৬-৭ ঘন্টার ভ্রমন
এই দীর্ঘ সময় খুবই আনন্দে কাটালাম আমরা সবাই মিলে।ছোটখাট একটা অনুষ্ঠান হয়ে গেল লঞ্চের ছাদে,যাতে ছাত্র-শিক্ষক সবাই অংশগ্রহন করলো।
গান,কৌতুক,অভিনয় সবই ছিল…
এভাবে কখন যে দিন কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না।বিকেল নাগাদ আমরা করামজল পৌছালাম।
করামজল আসলে একটা সাফারী পার্ক বলা চলে।এখানে ঢোকার মুখেই সুন্দরবনের একটা বিশাল মানচিত্র।পাশেই আছে বাঘ মামার কঙ্কাল, কুমিরের ডিম ইত্যাদি।
একটু সামনে এগুতেই দেখি হরিণ।হরিণগুলো সুন্দরবনের বন্য হরিণের মতো পালালোনা খাবারের লোভে।উম্মুক্ত বানরগুলো খুব মজা দিল সবাইকে।
এরপর সবাই ঢুকলাম বনের গভীরে অবশ্য কটকার মতো নয় এখানে বন বিভাগের বানানো সুদৃশ্য পথে আমরা রওনা হলাম ভিতরে।
এখানে দেখার তেমন কিছু নাই, তবে গাছের গায়ে নাম লেখা থাকায় গাছগুলো চিনতে পারলাম সবাই।
বন থেকে বের হয়ে গেলাম কুমিরের প্রজনন কেন্দ্র দেখতে।এখানে একটা পর্যবেক্ষণ টাওয়ার আছে যেখান থেকে পুরো করামজল দৃশ্যমান।
অবশেষে সব দেখা শেষে সবাই ফিরে এলো লঞ্চেআসার সময় অবশ্য সবাই সুন্দরবনের মধু কিনতে ভুল করলোনা।
অতঃপর শেষ হলো আমাদের সুন্দরবন ভ্রমন…
গত ৫দিনের সুখ স্মৃতি নিয়ে সবাই রওনা হলাম নিজ গন্ত্যব্যে।

লিখেছেনঃ আবু তৈয়ব

নামকরণ

বাংলায় “সুন্দরবন” -এর আক্ষরিক অর্থ “সুন্দর জঙ্গল” বা “সুন্দর বনভূমি”। সুন্দরী গাছ থেকে সুন্দর বনের নামকরণ হয়ে থাকতে পারে, যা সেখানে প্রচুর জন্মায়। অন্যান্য সম্ভাব্য ব্যাখ্যা এরকম হতে পারে যে এর নামকরণ হয়তো হয়েছে ‘সমুদ্র বন” বা “চন্দ্র-বান্ধে (বাঁধে)” (প্রাচীন আদিবাসী) থেকে। তবে সাধারণভাবে ধরে নেয়া হয় যে সুন্দরী গাছ থেকেই সুন্দরবনের নামকরণ হয়েছে।


ইতিহাস

মুঘল আমলে (১২০৩-১৫৩৮) স্থানীয় এক রাজা পুরো সুন্দরবনের ইজারা নেন। ঐতিহাসিক আইনী পরিবর্তনগুলোয় কাঙ্খিত যেসব মৌলিক পরিবর্তন হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে বিশ্বের প্রথম ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক তত্বাবধানের অধীনে আসা। ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীর এর কাছ থেকে স্বত্বাধিকার পাওয়ার পরপরই সুন্দরবন এলাকার মানচিত্র তৈরী করা হয়। বনাঞ্চলটি সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনার আওতায় আসে ১৮৬০ এর দিকে ভারতের তৎকালীন বাংলা প্রদেশে বন বিভাগ স্থাপনের পর থেকে।

 

সুন্দরবনের উপর প্রথম বন ব্যবস্থাপনা বিভাগের আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬৯ সালে। ১৯৬৫ সালের বন আইন (ধারা ৮) মোতাবেক, সুন্দরবনের একটি বড় অংশকে সংরক্ষিত বনভূমি হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয় ১৮৭৫-৭৬ সালে। পরবর্তী বছরের মধ্যেই বাকি অংশও সংরক্ষিত বনভূমির স্বীকৃতি পায়। এর ফলে দূরবর্তী বেসামরিক জেলা প্রশাসনের কর্তৃত্ব থেকে তা চলে যায় বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণে। পরবর্তীতে ১৮৭৯ সালে বন ব্যবস্থাপনার জন্য প্রশাসনিক একক হিসেবে বন বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়, যার সদর দপ্তর ছিল খুলনায়। সুন্দরবনের জন্য ১৮৯৩-৯৮ সময়কালে প্রথম বন ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণিত হয়।

 

১৯১১ সালে সুন্দরবনকে ট্র্যাক্ট আফ ওয়াস্ট ল্যান্ড হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়, যা না তো কখনো জরিপ করা হয়েছে আর না তো কোনদিন শুমারীর আধীনে এসেছে। তখন হুগলী নদীর মোহনা থেকে মেঘনা নদীর মোহনা পর্যন্ত প্রায় ১৬৫ মাইল (২৬৬ কি.মি.) এলাকা জুড়ে এর সীমানা নির্ধারিত হয়। একই সাথে চব্বিশ পরগনা , খুলনা ও বাকেরগঞ্জ এই তিনটি জেলা অনুযায়ী এর আন্তঃসীমা নির্ধারণ করা হয়। জলাধারসহ পুরো এলাকার আয়তন হিসেব করা হয় ৬,৫২৬ বর্গমাইল (১৬,৯০২ কি.মি)। জলবহুল সুন্দর বন ছিল বাঘ ও অন্যান্য বন্য জন্তুতে পরিপূর্ণ। ফলে জরিপ করার প্রচেষ্টা খুব একটা সফল হতে পারেনি। সুন্দরবনের নামকরণ হয়েছে খুব সম্ভবত এর প্রধাণ বিশেষ গাছ সুন্দরীর (Heritiera fomes) নাম থেকেই। এ থেকে পাওয়া শক্ত কাঠ নৌকা, আসবাবপত্র সহ বিভিন্ন জিনিস তৈরীতে ব্যবহৃত হয়। সুন্দরবন সর্বত্রই নদী, খাল, ও খাঁড়ি দ্বারা বিভক্ত, যাদের মধ্যে কয়েকটি স্টিমার ও স্থানীয় নৌকা উভয়ের চলাচল উপযোগী নৌপথ হিসেবে ব্যবহৃত হত কলকাতা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার মধ্যে যোগাযোগের জন্য।


ভৌগলিক গঠন

পুরো পৃথিবীর মধ্যে সর্ববৃহৎ তিনটি ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের একটি হিসেবে গঙ্গা অববাহিকায় অবস্থিত সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান যথেস্ট জটিল। দুই প্রতিবেশি দেশ বাংলাদেশ এবং ভারত জুড়ে বিস্তৃত সুন্দরবনের বৃহত্তর অংশটি ( ৬২% ) বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর; পূর্বে বালেশ্বর নদী আর উত্তরে বেশি চাষ ঘনত্বের জমি বরাবর সীমানা। উঁচু এলাকায় নদীর প্রধাণ শাখাগুলো ছাড়া অন্যান্য জলধারাগুলো সর্বত্রই বেড়িবাঁধ ও নিচু জমি দ্বারা বহুলাংশে বাঁধাপ্রাপ্ত। প্রকৃতপক্ষে সুন্দরবনের আয়তন হওয়ার কথা ছিলো প্রায় ১৬,৭০০ বর্গ কি.মি. (২০০ বছর আগের হিসাবে)। কমতে কমতে এর বর্তমান আয়তন হয়েছে পূর্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের সমান। বর্তমানে মোট ভূমির আয়তন ৪,১৪৩ বর্গ কি.মি. (বালুতট ৪২ বর্গ কি.মি. -এর আয়তনসহ) এবং নদী, খাঁড়ি ও খালসহ বাকি জলধারার আয়তন ১,৮৭৪ বর্গ কি.মি. । সুন্দরবনের নদীগুলো নোনা পানি ও মিঠা পানি মিলন স্থান। সুতরাং গঙ্গা থেকে আসা নদীর মিঠা পানির, বঙ্গপোসাগরের নোনা পানি হয়ে ওঠার মধ্যবর্তী স্থান হল এ এলাকাটি।

 

হাজার বছর ধরে বঙ্গোপসাগর বরাবর আন্তঃস্রোতীয় প্রবাহের দরুন প্রাকৃতিকভাবে উপরিস্রোত থেকে পৃথক হওয়া পলি সঞ্চিত হয়ে গড়ে উঠেছে সুন্দরবন। এর ভৌগলিক গঠন ব-দ্বীপীয় যার উপরিতলে রয়েছে অসংখ্য জলধারা এবং জলতলে ছড়িয়ে আছে মাটির দেয়াল ও কাদা চর। এতে আরো রয়েছে সমুদ্র সমতলের গড় উচ্চতার চেয়ে উঁচুতে থাকা প্রান্তীয় তৃণভূমি, বালুতট এবং দ্বীপ, যেগুলো জুড়ে জালের মত জড়িয়ে আছে খাল, জলতলের মাটির দেয়াল, আদি ব-দ্বীপীয় কাদা ও সঞ্চিত পলি। সমুদ্রসমতল থেকে সুন্দরবনের উচ্চতা স্থানভেদে ০.৯ মিটার থেকে ২.১১ মিটার।

 

জৈবিক উপাদানগুলো এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সামুদ্রিক বিষয়ের গঠন প্রক্রিয়া ও প্রাণী বৈচিত্রের ক্ষেত্রে। সৈকত, মোহনা, স্থায়ী ও ক্ষণস্থায়ী জলাভূমি, কাদা চর, খাঁড়ি, বালিয়াড়ি, মাটির স্তূপের মত বৈচিত্রময় অংশ গঠিত হয়েছে এখানে। ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ জগৎ নিজেই নতুন ভূমি গঠনে ভূমিকা রাখে। আবার আন্ত:স্রোতীয় উদ্ভিদ জগৎ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে জলে অঙ্গসংস্থান প্রক্রিয়ায়। ম্যানগ্রোভ প্রাণীজগৎ এর উপস্থিতি আন্তঃস্রোতীয় কাদা চরে ব্যষ্টিক অঙ্গসংস্থানিক পরিবেশ তৈরী করে। এটি পলিকে ধরে রাখে বীজের জন্য আনুভূমিক উপশিলাস্তর সৃষ্টির জন্য। অনন্ত বালিয়াড়ির সংগঠন ও বিবর্তন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিত হয় প্রচুর পরিমাণে থাকা xerophytic ও halophytic গাছ দ্বারা। লতা-পাতা, ঘাস ও হোগলা বালিয়াড়ি ও অসংগঠিত পলিস্তরের গঠনকে স্থিতিশীল করে।


জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

 

উপকূল বরাবর সুন্দরবনের গঠন প্রকৃতি বহুমাত্রিক উপাদানসমূহ দ্বারা প্রাভাবিত, যাদের মধ্যে রয়েছে স্রোতের গতি, ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক স্রোত চক্র এবং সমুদ্র উপকূলবর্তী দীর্ঘ সমুদ্রতটের স্রোত। বিভিন্ন মৌসুমে সমুদ্রতটের স্রোত যথেস্ট পরিবর্তনশীল। এরা ঘূর্ণীঝড়ের কারণেও পরিবর্তিত হয়।

 

এসবের মধ্য দিয়ে যে ক্ষয় ও সঞ্চয় হয়, যদিও এখনো সঠিকভাবে পরিমাপ করা সম্ভব হয়নি, তা ভূ-প্রকৃতির পরিবর্তনে মাত্রাগত পার্থক্য তৈরী করে। অবশ্য ম্যানগ্রোভ বনটি নিজেই এর পুরো ব্যবস্থার স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। প্রত্যেক মৌসুমী বৃষ্টিপাতের ঋতুতে বঙ্গীয় ব-দ্বীপের পুরোটিই পানিতে ডুবে যায় , যার অধিকাংশই ডুবে থাকে বছরের প্রায় অর্ধেক সময় জুড়ে। অববাহিকার নিম্নানঞ্চলের পলি প্রাথমিকভাবে আসে মৌসুমী বৃষ্টিপাতকালীন সময় সমুদ্রের চরিত্র এবং ঘূর্ণিঝড়ের মত ঘটনাগুলোর ফলে। অনাগত বছরগুলোতে গঙ্গা অববাহিকায় বসবাসকারীদের সবচেয়ে বড় যে সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে তা হলো সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি ।

 

উঁচু অঞ্চলে সাদুপানির গতিপথ পরিবর্তনের কারণে ভারতীয় ম্যানগ্রোভ আর্দ্রভূমিগুলোর অনেকগুলোতে সাদুপানির প্রাবাহ ১৯ শতকের শেষের দিক থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গিয়েছে। একই সাথে নিও-টেকটনিক গতির কারণে বেঙ্গল বেসিনও পূর্বের দিকে সামান্য ঢালু হয়ে গিয়েছে, যার ফলে সাদু পানির বৃহত্তর অংশ চলে আসছে বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবনে। ফলশ্রতিতে বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবনে লবণাক্ততার পরিমাণ ভারতীয় অংশের তুলনায় অনেক কম। ১৯৯০ সালের এক গবেষণা পত্রে বলা হয়েছে , “হিমালয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশের অবনতি বা “গ্রিন হাউস” এর কারণে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতিকে আশঙ্কাজনক করে তুলেছে এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যাদিও, ২০০৭ সালে -“ জলবায়ুর পরিবর্তন ও বিশ্ব ঐতিহ্যের পাঠ” শীর্ষক ইউনেস্কোর রিপোর্টে বলা হয়েছে যে মনুষ্যসৃষ্ট অন্যান্য কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের যে ৪৫ সে.মি. উচ্চতা বৃদ্ধি হয়েছে, তা সহ মনুষ্যসৃষ্ট আরও নানাবিধ কারণে সুন্দরবনের ৭৫ শতাংশ ধংস হয়ে যেতে পারে (জলবায়ু পরিবর্তনের উপর আলোচনায় প্রাকাশিত আন্তঃসরকার পরিষদের মত অনুযায়ী ২১ শতকের মধ্যেই)।


সুন্দরবনের উদ্ভিদ জগৎ


সুন্দরবনের প্রধান বনজ বৈচিত্রের মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে সুন্দরী (Heritiera fomes), গেওয়া (Excoecaria agallocha), গরান (Ceriops decandra) এবং কেওড়া (Sonneratia apetala) । ১৯০৩ সালে প্রকাশিত প্রেইন এর হিসেব মতে সর্বমোট ২৪৫টি শ্রেণী এবং ৩৩৪টি প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে সেখানে। প্রেইন এর প্রতিবেদনের পর সেখানে বিভিন্ন ম্যানগ্রোভ প্রজাতি ও তাদের শ্রেণীকরণের এর উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। বনজ প্রকৃতিতে খুব কমই আনুসন্ধান করা হয়েছে এসব পরিবর্তনের হিসেব রাখার জন্য । পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের বেশির ভাগ ম্যানগ্রোভে Rhizophoraceae, Avicenneaceae বা Laganculariaceae শ্রেণীর গাছের প্রাধাণ্য থাকলেও বাংলাদেশের ম্যানগ্রোভে প্রাধাণ্য Sterculiaceae এবং Euphorbiaceae শ্রেণীর গাছের।

 

ব-দ্বীপিয় নয় এমন অন্যান্য উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বনভূমি এবং উচ্চভূমির বনাঞ্চলের তুলনায় বাংলাদেশের ম্যানগ্রোভ বনভূমিতে উদ্ভিদ জীবনপ্রবাহের ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। পূর্ববর্তীটির তুলনায় Rhizophoraceae এর গুরুত্ব কম। উদ্ভিদ জীবনচক্রের ভিন্নতা ব্যাখ্যা করা হয়েছে উত্তর-পূর্বে বিশুদ্ধ পানি ও নিম্ন লবণাক্ততার প্রভাব এবং পানি নিষ্কাশন ও পলি সঞ্চয়ের ভিত্তিতে।

 

সুন্দরবনকে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে একটি আর্দ্র গ্রীষ্মমন্ডলীয় বনভূমি হিসেবে যা গড়ে উঠেছে সুগঠিত সৈকতে কেওড়া (Sonneratia apetala) ও অন্যান্য সামুদ্র উপকূলবর্তী বৃক্ষ প্রধাণ বনাঞ্চলে। ঐতিহাসিকভাবে সুন্দরবনে প্রধাণ তিন প্রকারের উদ্ভিদ রয়েছে যাদের চিহ্ণিত করা হয়েছে পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা, সাদু পানি প্রবাহের মাত্রা ও ভূপ্রকৃতির মাত্রার সাথে সম্পর্কের গভীরতার উপর ভিত্তি করে।

 

অঞ্চল জুড়ে সুন্দরী ও গেওয়া এর প্রাধাণ্যের পাশাপাশি বিক্ষিপ্তভাবে রয়েছে ধুন্দল (Xylocarpus granatum) এবং কেওড়া (Sonneratia apetala)। ঘাস ও গুল্মের মধ্যে Poresia coaractata, Myriostachya wightiana, শন (Imperata cylindrical)], নল খাগড়া (Phragmites karka), গোলপাতা (Nypa fruticans) রয়েছে সুবিন্যস্তভাবে। কেওড়া নতুন তৈরী হওয়া পলিভূমিকে নির্দেশ করে এবং এই প্রজাতিটি বন্যপ্রাণীর জন্য জরুরী , বিশেষ করে চিত্রা হরিণের (Axis axis) জন্য । বনভূমির পাশাপাশি সুন্দরবনের বিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে নোনতা ও মিঠা পানির জলাধার, আন্তঃস্রোতীয় পলিভূমি, , বালুচর, বালিয়াড়ি, বেলেমাটিতে উন্মুক্ত তৃণভূমি এবং গাছ ও গুল্মের এলাকা।

 

পরম্পরা বলতে সাধারণত বোঝানো হয় বিভিন্ন প্রজাতির গাছ দ্বারা কোন একটি এলাকার অনুক্রমিক অধিগ্রহণ[৯]। কোন একটা জমে উঠতে থাকা কাদা চরে, আদি প্রাজাতি ক্রমে বাইরে থেকে আসা নতুন প্রজাতি দ্বারা ধাপে ধাপে প্রতিস্থাপিত হতে থাকে। সর্বশেষে ঐ আবহাওয়ায় উপযুক্ত, এমন বিভিন্ন প্রাজাতির গাছের এক স্থানীয় শ্রেণী তৈরী হয[১০]। ট্রুপের মতে অনুক্রমিকতা সধারণত শুরু হয় নতুন পলি থেকে তৈরী হওয়া ভূমিতেref>Troup, R.S. 1921. The Silviculture of Indian Trees. Clarendon Press, Oxford. 1195 p.</ref>। নতুন গড়ে ওঠা এই ভূমিতে প্রথম পত্তন হয় গেওয়ার এবং এর সাথে Avicennia এবং গোল পাতা। পলি জমতে জমতে ভূমি যখন উঁচু হতে থাকে তখন সেখানে আসে অন্যান্য প্রজাতির গাছ। সবচেয়ে পরিচিত হলেও দেরীতে আসা প্রজাতিগুলোর মধ্যে একটি হল গেওয়া (Excoecaria agallocha) । উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে মাঝে মাঝে স্রোতে ভেসে যাওয়া ভূমিটিতে এরপর আসা শুরু করে সুন্দরী (Heritiera fomes)।


সুন্দরবনের প্রাণী জগৎ

 

সুন্দরবনে ব্যাপক প্রাণী বৈচিত্র বিদ্যমান। প্রাণী বৈচিত্র সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা সুন্দরবনের কিছু কিছু এলাকায় শিকার নিষিদ্ধ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ অভয়ারণ্যের মত, যেখানে শর্তহীনভাবে বনজ সম্পদ সংগ্রহ করা যায়না এবং বন্য প্রাণীর জীবনে সামান্যই ব্যাঘাত ঘটে। যদিও এটা স্পষ্ট যে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের প্রানী সম্পদ হ্রাস পেয়েছে[৩] এবং সুন্দরবনও এর বাইরে নয় । তারপরও সুন্দরবন বেশ অনেকগুলি প্রাণী প্রাজাতি ও তাদের সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য প্রজাতিদের টিকিয়ে রেখেছে। এদের মধ্যে বাঘ ও শুশুককে প্রাধাণ্য দিয়ে পরিকল্পনা করা হচ্ছে প্রানী বৈচিত্র সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা ও পর্যটন উন্নয়নের। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় সম্পূর্ণ বিপরীত পরিবেশে থাকা এ দুইটির অবস্থা এবং সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা সামগ্রিক প্রাণী বৈচিত্র এবং সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনার শক্তিশালী সূচক। ২০০৪ সালের হিসেব মতে সুন্দরবন ৫০০ রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল যা পৃথিবীতে বাঘের একক বৃহত্তম অংশ[১১]।

 

সুন্দরবনে নীল ঘাড় ওয়ালা মাছরাঙারও দেখা মিলে।সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান মৌলিক প্রকৃতির এবং যা বন্য প্রাণীর বিশাল আবসস্থল। বন্য প্রাণীর সংখ্যা এবং এর লালনক্ষেত্রের উপর মানুষের সম্পদ সংগ্রহ ও বন ব্যবস্থাপনার প্রভাব অনেক। কচ্ছপ (River terrapin – Betagur baska, Indian flap-shelled turtle – Lissemys punctata এবং Peacock soft-shelled turtle – Trionyx hurum), গিরগিটি Yellow monitor – Varanus flavescens ও Water monitor – Varanus salvator), অজগর (Python molurus) এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগার (Panthera tigris tigris) সুন্দরবনের স্থানীয় প্রজাতিগুলোর মধ্যে অন্যতম।

 

সুন্দরবনের একটি কুমির।এদের মধ্যে কিছু প্রজাতি সংরক্ষিত, বিশেষ করে বাংলাদেশ বন্যপ্রানী সংরক্ষণ আইন, ১৯৭৩ (P.O. 23 of 1973) দ্বারা। বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ (Hog deer – Axis procinus ও Swamp deer – Cervus duvauceli), মহিষ (Bubalis bubalis), গন্ডার(Javan rhinoceros – Rhiniceros sondaicus ও Single horned rhinoceros – Rhinoceros unicornis) এবং কুমিরের (Mugger crocodile – Crocodylus palustris) এর মত কিছু কিছু প্রজাতি সুন্দরবনে বিরল হয়ে উঠেছে ২১ শতকের শুরু থেকে[১২]।

 

সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে বিচিত্র জীব বৈচিত্রের আধার বাংলাদেশের সুন্দরবন বাণিজ্যিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ১২০ প্রজাতির মাছ, ২৭০ প্রাজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ সরীসৃপ এবং ৮ টি উভচর প্রাজাতির আবাসস্থল। এ থেকে বোঝা যায় যে বাংলাদেশের সুন্দরবনে বিভিন্ন প্রজাতির একটি বড় অংশ বিদ্যমান ( যেমন – ৩০ শতাংশ সরীসৃপ, ৩৭ শতাংশ পাখি ও ৩৭ শতাংশ স্তন্যপায়ী) এবং এদের একটি বড় অংশ দেশের অন্যান্য অংশে বিরল[১৩] Of these wildlife, Sarker has noted that two amphibians, 14 reptiles, 25 aves and five mammals are presently endangered.[১২]। সরকারের মতে এই প্রানী বৈচিত্রের মধ্যে ২ প্রজাতির উভচর, ১৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৫ প্রজাতির পাখি এবং ৫ প্রজাতির স্তনপায়ী বর্তমানে হুমকির মুখে। পাখি বিষয়ক পর্যবেক্ষণ, পাঠ ও গবেষণার ক্ষেত্রে পাখিবিজ্ঞানীদের জন্য সুন্দরবন এক স্বর্গ।


মানুষ খেকো বাঘ

 

২০০৪ সালের হিসেব মতে, সুন্দরবন প্রায় ৫০০ রয়েল বেঙ্গল টাইগার বাঘের আবাসস্থল যা বাঘের একক বৃহত্তম অংশ[১৫]। এসব বাঘ উল্ল্যেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ, গড়ে প্রতি বছরে প্রায় ১০০ থেকে ২৫০ জন, মেরে ফেলার কারণে ব্যপকভাবে পরিচিত। মানুষের বাসস্থানের সীমানার কাছাকাছি থাকা একমাত্র বাঘ নয় এরা। বাঘের অভায়ারণ্যে চারপাশ ঘেরা বান্ধবগড়ে , মানুষের উপর এমন আক্রমন বিরল। নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়ায় ভারতীয় অংশের সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে একটিও মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি।

 

একটি রয়েল বেঙ্গল টাইগারস্থানীয় লোকজন ও সরকারীভাবে দ্বায়িত্বপ্রাপ্তরা বাঘের আক্রমণ ঠেকানোর জন্য বিভিন্ন নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন। স্থানীয় জেলেরা বনদেবী বনবিবির প্রার্থণা ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করে যাত্রা শুরুর আগে। বাঘের দেবতার (Dakshin Ray) প্রার্থণা করাও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কাছে জরুরি সুন্দরবনে নিরাপদ বিচরণের জন্য। বাঘ যেহেতু সবসময় পেছন থেকে আক্রমণ করে সেহেতু জেলে এবং কাঠুরেরা মাথার পেছনে মুখোশ পরে। এ ব্যবস্থা স্বল্প সময়ের জন্য কাজ করলেও পরে বাঘ এ কৌশল বুঝে ফেলে এবং আবারও আক্রমণ হতে থাকে।সরকারী কর্মকর্তারা আমেরিকান ফুটবল খেলোয়াড়দের প্যাডের মত শক্ত প্যাড পরেন যা গলার পেছনের অংশ ঢেকে রাখে। এ ব্যবস্থা করা হয় শিরদাঁড়ায় বাঘের কামড় প্রতিরোধ করার জন্য যা তাদের পছন্দের আক্রমণ কৌশল।

 

এসব বাঘ কেন মানুষকে আক্রমণ করে তার কিছু অনুমিত কারণ এরকমঃ

* যেহেতু সুন্দরবন সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় অবস্থিত সেহেতু তুলনামূলকভাবে এখানকার পানি নোনতা।এখানকার অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে বাঘই মিঠাপানি খায়। কেউ কেউ মনে করে পেয়পানির এই লবণাক্ততার কারণে বাঘ সার্বক্ষণ অস্বস্তিকর অবস্থায় থাকে যা তাদের ব্যপকভাবে আগ্রাসী করে তোলে। কৃত্তিম মিঠাপানির হ্রদ তৈরী করে দিয়েও এর কোন সমাধান হয়নি।

* উঁচু ঢেউ এর কারণে বাঘের গায়ের গন্ধ মুছে যায় যা প্রকৃতপক্ষে বাঘের বিচরণ এলাকার সীমানা চিহ্ণ হিসেবে কাজ করে। ফলে নিজের এলাকা রক্ষায় বাঘের জন্য উপায় একটাই , আর তা হল যা কিছু অনুপ্রবেশ করে তা বাঁধা দেয়া।

* অন্য একটি সম্ভাবন এমন যে আবহাওয়ার কারণে এরা মানুষের মাংশে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ও ভারতের এ অঞ্চলে জলোচ্ছ্বাসে হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। আর স্রোতের টানে ভেসে যাওয়া এসব গলিত মৃতদেহ বাঘ খায়।

* আর একটি সম্ভাবনা হল এরকম যে, নিয়মিত উঁচু নিচু স্রোতের কারণে marsh-like এবং পিচ্ছিল হয়ে ওঠা এলাকায় বাঘের পশু শিকার করার কঠিন হয়ে যায়। আবার নৌকায় চড়ে সুন্দরবন জুড়ে মাছ ও মধু সংগ্রহকারী মানুষ বাঘের সহজ শিকার হয়ে ওঠে। এরকমও বিশ্বাস করা হয় যে মানুষ যখন কাজ বন্ধ করে বসে থাকে তখন বাঘ তাকে পশু ভেবে আক্রমণ করে।

* এছাড়াও মনে করা হয় যে আবাসস্থলের বিচ্ছিন্নতার কারণে এই অঞ্চলের বাঘ তাদের শিকার করার বৈশিষ্ট্য বদলে ফেলেছে যা ২০ শতক জুড়ে ঘটেছে। এশিয়ার বাকি অংশে বাঘের মানুষভীতি বাড়লেও সুন্দরবনের বাঘ মানুষকে শিকার বানানো বন্ধ করবেনা হয়তো।


অর্থনীতি


সুন্দরবনের জনসংখ্যা ৪ মিলিয়নের বেশি কিন্তু এর বেশির ভাগই স্থায়ী জনসংখ্যা নয়।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতিতে যেমন, ঠিক তেমন জাতীয় অর্থনীতিতেও সুন্দরবনের গুরুত্বপূর্ণ রয়েছে ভূমিকা । এটি দেশের বনজ সম্পদের একক বৃহত্তম উৎস। এই বন কাঠের উপর নির্ভরশীল শিল্পে কাঁচামাল জোগান দেয়। এছাড়াও কাঠ, জ্বালানী ও মন্ডের মত প্রাথাগত বনজ সম্পদের পাশাপাশি এ বন থেকে নিয়মিত ব্যপকভাবে আহরণ করা হয় ঘর ছাওয়ার পাতা, মধু, মৌচাকের মোম, মাছ, কাঁকড়া এবং শামুক-ঝিনুক। বৃক্ষপূর্ণ সুন্দরবনের এই ভূমি একই সাথে প্রয়োজনীয় আবাসস্থল, পুষ্টি উৎপাদক, পানি বিশুদ্ধকারক, পলি সঞ্চয়কারী, ঝড় প্রতিরোধক, উপকূল স্থিতিকারী, শক্তি সম্পদের আধার এবং পর্যটন কেন্দ্র।

 

এই বন প্রচুর প্রতিরোধমূলক ও উৎপাদমূলক ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৫১ শতাংশ জুড়ে সুন্দরবনের, বন থেকে আসা মোট আয়ে অবদান প্রায় ৪১ শতাংশ এবং কাঠ ও জ্বালনী উৎপাদনে অবদান প্রায় ৪৫ শতাংশ ( বিশ্ব খাদ্য সংস্থা, ১৯৯৫ )। অনেকগুলি শিল্প ( যেমনঃ নিউজপ্রিন্ট, দেয়াশলাই, হার্ডবোর্ড, নৌকা, আসবাবপত্র) সুন্দরবন থেকে আহরিত কাঁচামালের উপর নির্ভরশীল। বিভিন্ন অকাঠজাত সম্পদ এবং বনায়ন কমপক্ষে আধা মিলিয়ন উপকূলবর্তী জনসংখার জন্য উল্ল্যেখযোগ্য পরিমাণে কর্মসংস্থান ও আয়ের সুযোগ সৃস্টি করেছে । উৎপাদনমূখী ভূমিকার পাশাপাশি সুন্দরবন, ঘূর্ণিঝড়প্রবণ বাংলাদেশের উপকূলবর্তী জনসংখ্যা ও তাদের সম্পদের প্রাকৃতিক নিরাপত্তাবলয় হিসেবে ভূমিকা রাখে।

 

মানুষের বসবাস ও অর্থনৈতিক কাজে ব্যপক ব্যবহার হওয়া সত্ত্বেও এখনো সুন্দরবনের ৭০ শতাংশের কাছাকাছি পরিমাণ বনভূমি টিকে আছে, ১৯৮৫ সালে এমন মত জানায় যুক্তরাজ্যের ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট এডমিনিস্ট্রেশন (ও ডি এ) ।

 

১৯৫৯ সাল থেকে ১৯৮৩ সালের মধ্যে বনজ সম্পদের স্থিতির পরিমান হ্রাস পেয়েছে প্রধাণত দুইটি ম্যানগ্রোভ প্রাজাতির ক্ষেত্রে – সুন্দরী (Heritiera fomes) এবং গেওয়া। এই হ্রাসের পরিমাণযথাক্রমে ৪০ শতাংশ ও ৪৫ শতাংশ (ফরেস্টাল ১৯৬০ এবং ও ডি এ ১৯৮৫)। তাছাড়া, মাছ ও কিছু অমেরুদন্ডী প্রাণী ব্যতীত অন্যান্য বন্যপশু শিকারের ব্যপারে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সেখানে জীব বৈচিত্র হ্রাসের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে ( এ শতকে উল্ল্যেখযোগ্য হল কমপক্ষে ৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী ও ১ প্রজাতির সরীসৃপ) এবং ফলশ্রুতিতে বাস্তুসংস্থানের মান হ্রাস পাচ্ছে (আই ইউ সি এন ১৯৯৪) ।


বাংলাদেশের অভয়ারণ্য


বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবনের আয়তন প্রায় ৪,১১০ বর্গ কি.মি. । এর মধ্যে নদী, খাল ও খাঁড়ি রয়েছে প্রায় ১,৭০০ বর্গ কি.মি. যাদের প্রশস্ততা কয়েক মিটার থেকে শুরু করে কয়েক কি.মি. পর্যন্ত। জালের মত পরস্পর যুক্ত নৌপথের কারণে সুন্দরবনের প্রায় সব জায়গাতেই সহজে নৌকায় করে যাওয়া যায়। সুন্দরবনের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে ২টি বনবিভাগ, ৪টি প্রশাসনিক রেঞ্জ – চাঁদপাই, শরণখোলা, খুলনা ও বুড়িগোয়ালিনি এবং ১৬টি বন স্টেশন। বনটি আবার ৫৫ কম্পার্টমেন্ট এবং ৯টি ব্লকে বিভক্ত[১]। ১৯৯৩ সালে নতুন করে খুলনা বন সার্কেল গঠন করা হয়েছে বন সংরক্ষণের জন্য এবং তাতে একটি সংরক্ষক পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। বনবিভাগের প্রশাসনিক প্রধাণের পদটি খুলনাকেন্দ্রিক । প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য বিভাগীয় বন কর্মকর্তার অধীনে রয়েছে বহু সংখ্যক পেশাদার, অপেশাদের ও সহায়ক জনবল। ব্যবস্থাপনার কেন্দ্রীয় একক হল কম্পার্টমেন্ট। চারটি বন রেঞ্জের অধীনে থাকা ৫৫টি কম্পার্টমেন্ট স্পস্টতই নদী, খাল, খাঁড়ির মত প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট অনুযায়ী বিভক্ত।

 

বাংলাদেশে অভয়ারণ্য তিনটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন, ১৯৭৩ (P.O. 23 of 1973) দ্বারা। এগুলো হলোঃ

 

১. পূর্বাঞ্চলীয় সুন্দরবন অভয়ারণ্যঃ আয়তন প্রায় ৩১,২২৭ হেক্টর। মিঠাপানি ও সুন্দরী গাছের (Heritiera fomes) প্রাধাণ্যের সাথে সাথে গেওয়া (Excoecaria agallocha), পশুর (Xylocarpus mekongensis) ও কেওড়া (Bruguiera gymnorrhiza) রয়েছে বন্যাপ্রবণ এলাকাটি জুড়ে। সিংড়া (Cynometra ramiflora) হয় অপেক্ষাকৃত শুষ্ক মাটিতে, আমুর (Amoora cucullata) হয় জলপ্রধাণ এলাকায়, গরান (Ceriops decandra) হয় নোনা এলাকায় এবং গোল পাতা (Nypa fruticans) জলধারা বরাবর হয়।

 

২. দক্ষীণাঞ্চলীয় সুন্দরবন অভয়ারণ্যঃ বিস্তৃত ৩৬,৯৭০ হেক্টর এলাকা জুড়ে। এলাকাটিতে লবণাক্ততার বিশাল মৌসুমী তারতম্যের প্রমাণ রয়েছে। তুলনামূলকভাবে দীর্ঘকালীন লবণাক্ততাপ্রবণ এলাকাটির প্রধাণ বৃক্ষ প্রজাতির মধ্যে রয়েছে গেওয়া। এটি প্রায়ই সেসব স্থানে জন্মায় যেখানে সুন্দরী অত সফলভাবে বংশ বিস্তার করতে পারেনা।

 

৩. পশ্চিমাঞ্চলীয় সুন্দরবন অভয়ারণ্যঃ ৭১,৫০২ হেক্টর এলাকা জুড়ে অবস্থিত। এ এলাকার তুলনামূলকভাবে শুষ্ক ভূমি ও নদীর তীরে গেওয়া, গরান ও হন্তাল জন্মে।

Follow Us @VisitSundaebon