Wednesday, April 25, 2018

সুন্দরবনঃ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সম্পর্কে কিছু তথ্য - ১০

উদবিড়াল : সুন্দরবনে উদ বিড়াল প্রচুর পরিমানে বাস করে। এর প্রধান কারণ হল সুন্দরবনে মাছের প্রাচুর্যতা। উদ বিড়ালের প্রধান কারণ হল মাছ। উদবিড়াল পানি ও ডাংগায় বাস করে। এরা ম্ছা, কাঁকড়া, ব্যাঙ, চিংড়ি প্রভৃতি খেয়ে জীবনধারণ করে। সন্দরবনে এক শ্রেনীর জেলে আছে যারা উদবিড়াল দিয়ে মাছ ধরে। এসব জেলেদের উদ জেলে বলে। উদ বিড়াল দিয়ে মাছ ধরার দৃশ্য খুবই সুন্দর। উদ বিড়াল জেলেরা বন হতে ধরে প্রথমে প্রশিক্ষন দেয় কিভাবে মাছ ধরতে হবে। তারপর এদের কাজে লাগায়। জেলেরা জাল পেতে উদ বিড়ালের গলায় লম্বা রশি বেধে পানিতে নামিয়ে দেয়। উদবিড়াল পানিতে মাছ তাড়িয়ে জালে সমবেত করে। আর জেলেরা জাল তুলে, প্রচুর মাছ পাছ। অবশ্য উদ বিড়াল মাছ তাড়ানোর সময় নিজেও কিছু মাছ তার মনিব জেলের অগোচরে খেয়ে ফেলে।

পাখি : বিচিত্র ধরনের ও রং বেরংগের পাখি সুন্দরবনে বাস করে। সুন্দরবনে প্রায় ১৮৬ প্রজাতির পাখি পাওয়া যায়। অপরদিকে বাংলাদেশের লোনা পানির বনে ২৬০ ধরনের পাখি দেখা যায়। সুন্দরবনে উল্লেখযোগ্য পাখির মধ্যে রয়েছে মদন টেক, মাছরাঙ্গা, চিল, বক, সারস প্রভৃতি। সুন্দরবনে যে সব পাখি বাস করে এদের মধ্যে বেশীর ভাগই মৎস্য ভোজী পাখি। এর কারণ হল সুন্দরবনে কোন শস্য ক্ষেত নেই। পাখির খাওয়া উপযোগী কোন ফল গাছ নেই। সুন্দরবনে আছে শুধু মাছ আর মাছ। সেজন্যে সুন্দরবনে মৎস্য ভোজী পাখির আবাস স্থল গড়ে উঠেছে। বিশাল সুন্দরবনে হাজার হাজার পাখি বসবাস করে। পাখির কলকাকলিতে ক্ষনিকের তরে গভীর বনের নির্জনতা ভেংগে যায়। দলে দলে পাখি উড়ে বনের এক স্থান হতে অন্যস্থানে গমন করে। মাছ রাঙ্গা, বক, মদন টেক মাছ ধরার আশায় এক পা তুলে ্একাগ্র চিত্তে পানির দিকে চেয়ে থাকে মৎস্য ভক্ষনের আশায়। এ দৃশ্য বনের সর্বত্র দেখা গেলেও বেশী দেখা যায় কচিখালী ও নীলকমল অভয়ারন্যের নদীর পাড়ে। স্থায়ী পাখি ছাড়াও বিচিত্র ধরনের মৌসুমী পাখি সুন্দরবনে আসে। শীত মৌসুমে এ সব পাখি আসে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে অষ্ট্রেলিয়া, সাইবেরিয়া প্রভৃতি দেশ হতে সুন্দরবনে। শীতকালটা এরা কাটিয়ে দেয় সুন্দরবনের দুবলা, নীলকমল, মান্দারবাড়িয়া, কচিখালী প্রভৃতি চরে। এদের অবাধ বিচরণ ও কোলাহলে এ সব নির্জন স্থান মুখরিত হয়ে উঠে। কোন কোন মৌসুমী পাখি সুন্দরবনে যাত্রা বিরতিও করে। প্রায় আশি প্রজাতির মৌসুমী পাখি সুন্দরবনে আসে। শীতকালে দুবলা, নীলকমল, মান্দারবাড়িয়া ও কচিখালীতে মৌসুমী মাছ ধরার ধুম চলে। তৈরী হয় টন কে টন শুটকি মাছ। আর দেশী-বিদেশী পাখি মাছের লোভে এ সব চরাঞ্চলে ভ্রমন করে দল বেধে। পাখির দল মাছের লোভে এত মত্ত হয় যে পর্যটক বা জেলেরা এদের কাছে গেলেও এরা কোন ভয় পায়না। মনের অনাবিল আনন্দে মাছ খায় ওরা। মাঝে মধ্যে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি শুটকি মাছ শুকানো অবস্থায় চড়াও হয়। এক নিমিষে অনেক মাছ নিয়ে পাখিরা পালায়ন করে। তাই জেলেদের মাছ শুকানোর সময় পাখি তাড়ানোতে সর্বদা ব্যস্ত থাকতে হয়। পর্যটকদের সুন্দরবনে ভ্রমনের সময় একটা বড় আকর্ষন হল বিচিত্র ধরনের পাখি পর্যবেক্ষন করা। সুন্দরবনে এমন কতগুলো পাখি আছে যে গুলো বাংলাদেশের অন্য এলাকায় বিরল।বর্তমানে আমরা সুন্দরবনের যে পাখি দেখি এর মধ্যে ২৫ ভাগ মৌসুমী পাখি। পাখি সংরক্ষন ও উন্নয়নের জন্য সুন্দরবনে দু’টি পাখি অভয়ারন্য রয়েছে। যথা- চুনকুড়ি খাল পাখি অভয়ারন্য এবং জিউধারা পাখি অভয়ারন্য। চুনকুড়ি খাল পাখি অভয়ারণ্য সুন্দরবনের উত্তর পশ্চিম সীমান্তে সাতক্ষীরা রেঞ্জের কদমতলা ষ্টেশনের নিকট ৪৭ নং কম্পার্টমেন্টে অবস্থিত। চুনকুড়ি পাখি অভয়ারন্যটি বেশ পুরাতন। স্বাধীনতা উত্তর চুনকুড়ি পাখি অভয়ারণ্য হতে গাছ কাটার ফলে পাখির বাসা, ডিম ও পাখি ছানার প্রভুত ক্ষতি হয়। এর ফলে উক্ত পাখি অভয়ারণ্য হতে অনেক পাখি অন্যত্র চলে যায়।

বন মোরগ : বন মোরগ সুন্দরবনে প্রচুর পরিমানে দেখা যায়। বন মোরগের কুক কুরু কু ডাকে বনের নির্জনতা ক্ষনিকের তরে হারিয়ে যায়। বন মোরগ সুন্দরবনের সর্বত্র ব্যাপকভাবে বাস করে। বন মোরগের অবাধ বিচরণ নীলকমল বন্যপ্রাণী অভয়ারন্যে পর্যবেক্ষন করা যায়। সকালে অথবা বিকেলে বন মোরগ দল বেঁধে নীলকমল নদীর পাড়ে খাদ্যের অনে¦ষনে ঘুরা ফেরা করে। এক এক দলে ৭-৮ টি বন মোরগ দেখা যায়। অধিকাংশ বন মোরগের গায়ের রং লাল। পেছনের পাখায় লাল কালছে ভাব পরিলক্ষিত হয়। নীলকমল অভয়ারন্য কেন্দ্রে একটি পুকুর আছে। অনেক সময় বন মোরগ দল বেঁধে পানি পান রত অবস্থায় সেখানে দেখা যায়। এ দৃশ্য অবলকনে মনে বেশ আনন্দ অনুভুত হয়। কটকা এবং কচিখালীতে বন্যপ্রাণী অভয়ারন্যে কেন্দ্রের আশেপাশে বন মোরগের অবাধ বিচরণ পর্যবেক্ষন করা যায়।

শুষক : সুন্দরবনের ডাংগায় যেমন আছে বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রানী তেমনি পানিতে বাস করে পৃথিবীর বিরল জলজ বন্যপ্রাণী যথা- শুষক, ডলফিন, হাংগর, কুমির, সাপ, গুইসাপ প্রভৃতি। এর মধ্যে শুষক প্রচুর পরিমানে সুন্দরবনের নদী-নালায় সর্বত্র দেখা যায়। হাজার হাজার শুষক সুন্দরবনের নদী ও খালে বাস করে। সুন্দরবনে পথ চলার সময় এদের বিচরণ ও অবস্থান সহজে অনুমান করা যায়। পানিতে লক্ষ করলে দেখা যায় যে, একটি মাছ যেন পানির উপর লাফ দিয়ে আবার পানিতে মিশে গেল। এ দৃশ্য সর্বত্র দেখা যায়। এটা আসলে সাধারণ মাছ নয়। এগুলো হল শুষকের কাজ।

হাংগর : সুন্দরবনে প্রচুর পরিমানে হাংগর বাস করত। কালের বিবর্তনে অধুনা সুন্দরবনে হাংগর নেই বললেই চলে। হাংগর খুব দুধর্ষ জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী। সময় ও সুযোগ পেলে এরা কুমিরকেও আক্রমন করে। সুন্দরবনে ভ্রমনের সময় হাংগরের উপস্থিতি অবলোকন এক বিরণ ঘটনা।

সুন্দরবনের মাছ : সুন্দরবনে বৃক্ষের পাশাপাশি মৎস্য সম্পদে পরিপূর্ণ। বন্য প্রানী, মৎস্য ও বন এ তিন নিয়ে সুন্দরবন। বিভিন্ন প্রকারের অজস্য মাছ রয়েছে সুন্দরবনে। এক কথায় সুন্দরবন মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধশালী। বাংলাদেশে বিভিন্ন মৎস্য আহরণ এলাকা রয়েছে। এর মধ্যে সুন্দরবন অন্যতম। হাজার হাজার জেলে সুন্দরবন এবং তদসংলগ্ন বঙ্গোপসাগর হতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছে। সুন্দরবনে মাছের সৃখ্যাতি আছে দেশ জুড়ে। শুধু কি তাই। সুন্দরবনের মাছের সুখ্যাতি বিদেশেও আছে। সুন্দরবনের চিংড়ি, ইলিশ, কাঁকড়া প্রভুতি মাছ দেশের চাহিদা মিটিয়ে প্রচুর পরিমানে বিদেশে রপ্তানী করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে। প্রতি বছর প্রায় ৩(তিন) লক্ষ জেলে সুন্দরবনে মাছ ধরে। সুন্দরবনে বিভিন্ন ধরনের মাছ আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মাছ হল ইলিশ, ভেটকি, পাংগাশ, গলদা চিংড়ি, সেলুন, রিঠা, পোয়া, খান মাগুর, দাতিনা, ছুড়ি, লইট্যা, ফাইস্যা, রেখা, বোচা, ট্যাংরা, বাটা, ইত্যাদি। বাংলাদেশে মোট ৪৭৪ প্রজাতির মাছ আছে। তস্মধ্যে সুন্দরবনে ১২০ প্রজাতির মাছ আছে। প্রতি বছর সুন্দরবন হদে গড়ে ৭ হাজার মেট্রিক টন মাছ আহরণ করা হয় যা বৃহত্তর খুলনায় ৩৫% আহরিত মাছের সমান। সুন্দরবনের মাছ আয়োডিন যুক্ত এবং খেতেও বেশ সুস্বাদু। সমুদ্রের লোনা পানি ও উপর থেকে আসা মিঠা পানির সংমিশ্রিত পানিতে গড়ে উঠা এসব মাছের বৈশিষ্ট ও গুনাবলী অন্যান্য মাছ থেকে পৃথক। সুন্দরবনের মাছ বলিষ্ট হয় বেশ। মাছের প্রাচুর্য হেতু সারা বছর জেলেরা সুন্দরবনে মাছ ধরে থাকে। আবার বিশেষ মৌসুমেও সুন্দরবনে মাছ ধরার প্রবনতা লক্ষ্য করা যায়। তাই সুন্দরবনের মৎস্য আহরনকে প্রধানতঃ ২ ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- (১) সারা বছর মাছ ধরা, (২) মৌসুমী মাছ ধরা।
.
-চলবে

No comments:

Post a Comment

Follow Us @VisitSundaebon