মৌসুমী মাছ ধরার সময় সুন্দরবন হতে প্রচুর শুটকি মাছ তৈরী করা হয়। মৌসুমী মৎস্য সুন্দরবনের দুবলা, কচিখালী, নীলকমল ও মান্দারবাড়িয়া জেলে পল্লী হতে নদীর মোহনা এবং সুন্দরবন সংলগ্ন সমুদ্র হতে আহরণ করা হয়। প্রতি বছর অক্টোবর মাস হতে ফেব্র“য়ারী মাস পর্যন্ত মৌসুমী মৎস্য আহরণ করা হয়। অবশ্য মৌসুমী মৎস্য আহরনের বেশির ভাগ মাছই সমুদ্র হতে ধরা হয়। মাছ ধরার পর বেশির ভাগ মাছই রোদে শুকিয়ে শুটকি করা হয়। কিছু মাছ বা সাদা মাছ কাঁচা বিক্রি করা হয়। বাংলাদেশে বিভিন্ন স্থানে শুটকি মাছ তৈরী করা হয়। যথা- কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া, মহেশখালী ও গোবর কাটা, পটুয়াখালীর সোনারচর, বেলাগাছিয়া ও মহিপুর এবং চট্রগ্রামের সন্দ¡ীপে প্রচুর শুটকি মাছ করা হয়। তম্মধ্যে সুন্দরবন বাংলাদেশের অন্যতম শুটকী মাছ প্রক্রিয়াজাত এলাকা।
সুন্দরবনে যে সব মাছ হতে শুটকি করা হয় সে গুলো সুরি, লইট্যা, পোমা, ফাইস্যা, ডাকচান্দা, ছোট চিংড়ি, পালকা, ছোট পোমা, বৈরগী মাছ, রুপচান্দা, মেদ, শাপলাপাতা, মধু (কামোট), রামসুস ইত্যাদি। দুবলা সুন্দরবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মৎস্য আহরণ কেন্দ্র। যুগ যুগ ধরে জেলেরা এখানে মাছ ধরে শুটকি তৈরী করে। উনবিংশ শতাব্দির শেষ দিক হতে দুবলাতে শুটকি মাছ তৈরীর কথা জানা যায়। দুবলা সুন্দরবনের পুর্ব-দক্ষিণ অংশে বঙ্গোপসাগরের পাড়ে অবস্থিত। কম্পার্টমেন্ট ৮ ও ৪৫ দুবলার অন্তর্গত। বিভিন্ন চরে মৌসুমে অস্থায়ী ঘর বেঁধে জেলেরা মৎস্য আহরণ ও প্রক্রিয়াজাত করে। দুবলার অধীন ১৩টি মৎস্য আহরণের চর আছে। সে গুলো হল অফিস কিল্লা, মাঝের কিল্লা, মেহের আলী, আলোরকোল, কবর খালী, ছোট আমবাড়িয়া, বড় আমবাড়িয়া, মানিক খালী, নারিকেল বাড়িয়া, শেলার চর, কটকার চর ও কোকিলমনি।
বর্তমানে সারা দুবলায় মাছ ধরা হলেও জেলেপল্লী বসে শীত মৌসুমে। অর্থাৎ কার্তিক হতে মাঘ মাস পর্যন্ত এ সময় বহদ্দারের অধীনে মৌসুমী মাছ ধরা হয়। বহদ্দার হল একদল জেলের মালিক। চট্রগ্রাম হতে আগত বহদ্দারদের চট্রগ্রাম বহদ্দার বা মৎস্য ব্যবসায়ী বলা হয়। আর খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, সাতক্ষীরা প্রভৃতি স্থান হতে আগত জেলে মালিকদের স্থানীয় বহদ্দার বলে। চট্রগ্রামের বহদ্দাররা মাত্র ৩টি স্থান যথা অফিস কিল্লা, মাঝের কিল্লা ও মেহের আলীতে অস্থায়ী ঘরবাড়ী তৈরী করে মাছ ধরে ও প্রক্রিয়াজাত করে। মৌসুমী জেলে পল্লীগুলোতে মাছ শুকানো দৃশ্য খুবই অপুর্ব। এ সব জেলে পল্লীতে অস্থায়ী ঘরে ভরে যায়। লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। জেলেদের কোলাহলে গহীণ অরন্যের নিস্তব্ধতা কয়েক মাস হারিয়ে যায়। বন্যপ্রাণীরা চোখের আড়ালে থাকে দিনের বেলা। রাতে জেলে পল্লীর চরে অবাধে বিচরণ করে। দিনের বেলা অসংখ্য পায়ের দাগ দেখা যায় হরিনের। মাঝে মধ্যে বাঘও আসে। সব সময় জেলেদের বাঘের ভয়ে রাত কাটাতে হয়। দেশী বিদেশী পর্যটক আসে জেলে পল্লী পরিদর্শনে। মাছ ধরার ও শুটকি তৈরী করার কলা কৌশল শুনে ও দেখে সবই মুগ্ধ হয়ে যায়। সঞ্চয় করে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা। সাথে করে নিয়ে যায় বিভিন্ন ধরনের শুটকি মাছ তাদের প্রিয়জনদের উপহার দিতে। কি অপুর্ব অভিজ্ঞতা। নিজে চোখে না দেখলে বুঝা বেশ কঠিন। এ সব জেলে পল্লীগুলোতে অস্থায়ী দোকান পাট বসে। এ সব দোকানে চাউল, ডাল, তরিতরকারী সহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র পাওয়া যায়। জিলাপী ও চায়ের দোকান গড়ে উঠে জেলে পল্লীতে।
সবচেয়ে বেশী আকর্ষণীয় হল দুবলার চর জেলে পল্লী। জেলেদের রসদ সরবরাহের জন্য ভাসমান দোকানও থাকে কিছু। নৌকায় করে এরা জেলেরা যেখানে থাকে সেখানে যায়। ভাসমান দোকানদারদের কাছে চাউল, ডাল, বিড়ি, সিগারেট, বিস্কুট সহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র থাকে। শুটকি মাছ তৈরীর দিক দিয়ে দুবলা হচ্ছে সবচেয়ে বড় কেন্দ্র। দুবলার পরেই নীলকমলের স্থান। নীলকমল নদীর নাম অনুসারেই কেন্দ্রের নাম হয়েছে নীলকমল। নীলকমল মৎস্য আহরণ কেন্দ্রের অধীনে ৯টি মৎস্য আহরণের চর বা স্থান আছে। এগুলো হল মরাচান্দাবুনিয়া, চান্দাবুনিয়া, বন্দেরচর, গলাকাটা চর, মরা খাল, কলাতলার চর, বালির গাং, কালির চর ও সিগন্যাল টাওয়ার। এর মধ্যে বালির গাং সবচেয়ে বড়। সেখানে শুটকি মাছ শুকানোর দৃশ্য ছাড়া চিংড়ি গ্রেডিং করার পদ্ধতি ও সুন্দরবনের অভ্যন্তর নদীর মোহনায় মাছ ধরার দৃশ্যাবলী অবলোকন করার অপুর্ব সুযোগ আছে। এখান থেকেই বিখ্যাত পুটনী আইল্যান্ড ও মান্দারবাড়িয়া অভয়ারণ্য ও মৎস্য আহরণ কেন্দ্র দেখা যায়।
জেলেরা যে অস্থায়ী ঘরবাড়ী তৈরী করে তাকে ডিপু বলে। ডিপুতে দু’ ধরনের ঘর থাকে। কিছু ঘর বসবাস করার জন্য এবং কিছু ঘর থাকে শুটকি মাছ রাখার জন্য। মাছ ধরে ডিপুতে আনার পর মাছ বাছাই করা হয়। আবর্জনা বেছে ফেলে দেয়া হয়। পচা থাকলে আলাদা করে বর্জ হিসেবে শুকানো হয়। ভাল মাছগুলোকে প্রজাতি হিসেবে গ্রেডিং করা হয়। তারপর মাচাং, পাটি এবং আড়া তৈরী করে রোদে শুকানো হয়। এ সময় মাছের পচা গন্ধে এলাকা মুখরিত হয়ে যায়। হঠাৎ করে গেলে সেখানে চলাফেরা করতে ভীষন অসুবিধা হয়। জেলেরা থাকতে থাকতে অভ্যাস হয়ে যাওয়ায় তাদের কাছে পরিবেশটা স্বাভাবিক মনে হয়। বনের গাছপালা কেটে জেলেরা ঘরবাড়ি, মাচাং, আড়া প্রভৃতি তৈরী করে। বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শুকাতে বিভিন্ন রকম সময় লাগে। যেমন- ফাতরা/পোয়া ৩-৪ দিন, সুরি ৭-৮ দিন, লইট্যা ৩-৪ দিন, চিংড়ি ২ দিন, পলকা ১০-১৫ দিন, শাপলা পাতা ৭-৮ দিন, কমোট ৬-৭ দিন, রপচান্দা ৫-৬ দিন, লান্ডা ১৫ দিন। এর মধ্যে শাপলা পাতা ও কমোট কেটে টুকরা টুকরা করে শুকানো হয়।
জেলে পল্লীতে ডায়রিয়া সহ বিভিন্ন অসুখ দেখা দেয়। প্রতি বছর ডায়রিয়ায় বেশ কিছু জেলে মারা যায়। তাই জেলেদের চিকিৎসার জন্য দুবলার অস্থায়ী চিকিৎসা কেন্দ্র সরকারীভাবে ভোলা হয়। উক্ত কেন্দ্র বাগেরহাট সিভিল সার্জনের অধীনে থেকে একটি ৩-৪ জন বিশিষ্ট মেডিকেল টিম জেলেদের চিকিৎসা করে এবং প্রয়োজন অনুসারে ঔষধ সরবরাহ করে। জেলে পল্লীগুলোতে রোগ বালাই কম হওয়ার জন্য বন বিভাগ কর্তৃক কতগুলো নীতি অনুসরণ করার জন্য জেলেদের বলা হয়। যথা- কোন মৎস্য ব্যবসায়ী / চিকিৎসা সহকারী ও পর্যাপ্ত ওষধ ব্যবস্থা না করে দুবলা চরে বা সুন্দরবনে মাছের ব্যবসা করতে পারবে না।, জেলে পল্লী এলাকায় ঝুলন্ত পায়খানা নির্মান করা যাবে না, স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশিত স্বল্প মূল্যের পায়খানা তৈরী করতে হবে, মাছের বর্জ মাটিতে পুতে রাখতে হবে এবং সরকার অনুমোদিত বিলিচিং পাউডার বা অন্য ঔষধ প্রয়োগ করে দুর্গন্ধ বিনাশের ব্যবস্থা নিতে হবে, মাছ বাছাইয়ের পর দিন মজুরদের হাত ভালভাবে সাবান দিয়ে ধোয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ডিপু বা জেলে ঘরের পাশের নর্দমা জন স্বাস্থ্য দপ্তর কর্তৃক অনুমোদিত বিলিচিং পাউডার নিয়মিত দিতে হবে যাতে মাছি দ্বারা ডায়রিয়া ছড়াতে না পারে। শর্ত অমান্যকারীদের পারমিট বাতিল করা হবে।
.
চলবে
No comments:
Post a Comment