সুন্দরবন থেকে ভেটকি, কাইন মাগুর, ইলিশ, চিংড়ি মাছ ও কাকড়া আহরণ : সুন্দরবনের অভ্যন্তরে নৌকা থেকে যে সব জেলে মাছ ধরে তারা শুধু মাছই ধরে, তারা বাজারে এসে মাছ বিক্রি করে না। এক শ্রেণীর লোক আছে যারা জেলেদের নিকট হতে মাছ কিনে শহরে এনে বিক্রয় করে। তাদের মৎস্য ব্যবসায়ী বলে। মৎস্য ব্যবসা করতে হলে সুন্দরবন বন বিভাগের মৎস্য লাইসেন্স করতে হয়। মৎস্য লাইসেন্স না থাকলে সুন্দরবন হতে মাছ পরিবহন করা যায় না। অনেক জেলে ভেটকি, কাইন মাগুর প্রভৃতি মাছ বরশি দিয়ে ধরে। এ সব বরশি কে দড়ি বরশি বলে। একটি দড়ি বরশি ৩-৪ শত হাত লম্বা হয়। লম্বা সুতার দড়ির মধ্যে ২ হাত অন্তর অন্তর ২-৩ হাত লম্বা সুতার বরশি বেধে ঝুলানো থাকে। কামোট মাছ কেটে রোদে আধা শুকিয়ে খন্ড খন্ড করে কেটে আদার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ১০-১২ কেজি ওজনের ভেটকি মাছ সুন্দরবনে পাওয়া যায়। এ সব জেলেদের নৌকা ১০০-১৫০ মন ধরে এমন আকারের হয়। নৌকার এক অংশে বরফ থাকে। মাছ ধরার সাথে সাথে তারা মাছ বরফে দিয়ে রাখে। ইলিশ ও চিংড়ি মাছ ছাড়া যে সব মাছ সুন্দরবনে ধরা হয় এদের সাদা মাছ বলে। প্রতি বছর বিপুল পরিমান সাদা মাছ সুন্দরবনে ধরা পড়ে।
ইলিশ মাছ ধরা : ইলিশ সুন্দরবনের একটি আকর্ষণীয় মাছ। এ মাছের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। কয়েক হাজার জেলে প্রতি বছর সুন্দরবনে ইলিশ মাছ ধরে। ইলিশ মাছ ধরার মৌসুম শুরু হয় জুলাই মাস থেকে এবং শেষ হয় অক্টোবর মাসে। সমগ্র সুন্দরবনে ইলিশ মাছ পাওয়া যায় না। শুধু বলেশ্বর, পশুর, ভোলা ও সুপতি নদীতে ইলিশ মাছ পাওয়া যায়। শরনখোলা রেঞ্জের বগী, সুপতি, কচিখালী, দুবলা জেলে পল্লী টহল ফাঁড়ি এবং চাঁদপাই রেঞ্জের ঢাংমারী ও চাদপাই হতে ইলিশ মাছের পাশ দেয়া হয়। সবচেয়ে বেশি ইলিশ মাছ ধরা পড়ে সুপতি ও কচিখালী এলাকায়। দুবলা ও কচিখালীর জেলেরা বঙ্গোপসাগর হতেও ইলিশ আহরণ করে। সুন্দরবনের ইলিশ মাছ মানে ও গুনে বেশ উন্নত। খেতে বেশ মজা লাগে। বনে বেড়াতে গেলে জেলেদের নিকট হতে তাজা ইলিশ মাছ কিনতে পাওয়া যায়। জেলেরা বেশ উদার। অনুরোধ করলেই তারা বড় বড় ইলিশ দেয়। সুন্দরবনে বড় বড় ট্রলার দিয়ে জেলেরা ইলিশ মাছ ধরে। একটি ইলিশ মাছের জাল ৩০০-৪০০ মিটার লম্বা হয়। ঝড় বাদলকে উপেক্ষা করে জেলেরা সুন্দরবন ও তদসংলগ্ন সমুদ্র হতে ইলিশ মাছ আহরণ করে। ইলিশ মাছ ধরে জেলেরা বরফ দিয়ে রাখে। সব জেলেদের কাছে বরফ থাকে না। ছোট ছোট জেলেরা ইলিশ মাছ ধরার পর তাদের থেকে ইলিশ মাছ ব্যবসায়ীরা কিনে বরফে দিয়ে রাখে। তারপর তারা খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর প্রভৃতি স্থানে ইলিশ মাছ বিক্রয় করে। ভরা মৌসুমে সুন্দরবনে ইলিশ মাছের দাম কম থাকে। প্রতি বছর হাজার হাজার মন ইলিশ মাছ সুন্দরবন হতে ধরা হয়। দেশের চাহিদা মিটিয়ে এ সব মাছ বিদেশে রপ্তানী করে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা আসে। প্রতি জেলেকে প্রতিদিন কমছে কম ৩ কেজি ইলিশ মাছের রাজস্ব জমা দিতে হবেই। ৯ ইঞ্চির নিচে ইলিশ মাছ ধরা নিষেধ।
চিংড়ি মাছ ধরা : অক্টোবর হতে ফেব্র“য়ারী পর্যন্ত সুন্দরবন হতে প্রচুর পরিমানে গুড়া চিংড়ি আহরণ করা হয়। ছোট ছোট ছিদ্র যুক্ত জাল দিয়ে গুড়া চিংড়ি ধরা হয়। নীলকমল, দুবলা, কচিখালী, টিয়ার চর হতে গুড়া চিংড়ি ধরা হয়। গুড়া চিংড়ি ধরার পর জেলেরা এর আকার অনুযায়ী চার ভাগে ভাগ করে যথা- চাকা চিংড়ি, চালি চিংড়ি, টাইগার চিংড়ি, মটকা চিংড়ি। চাকা চিংড়ির দাম বেশি। এ চিংড়ি খেতে খুব সুস্বাদু। বেসন দিয়ে চাকা চিংড়ি ভেজে খাওয়া খুবই সুস্বাদু।
কাঁকড়া ধরা : কাঁকড়া সুন্দরবনের একটি গুরুত্বপুর্ন মৎস্য সম্পদ। কাঁকড়া ধরার জেলেরা শুধু কাকড়া ধরে। পিরোজপুর, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট হতে জেলেরা এসে সুন্দরবনে কাঁকড়া ধরে। দড়ি বরশি দিয়ে কাকড়া ধরা হয়। এধরনের একটি দড়ি বরশি ৩-৪ শ হাত লম্বা হয়। কুইচ্চা কেটে রোদে আধা শুকায়ে আদার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। নীলকমল, সুপতি, কচিখালী, দুবলা এলাকার নদী-নালা ও শিবসা, হংসরাজ, খোলপেটুয়া, কপোতাক্ষ প্রভৃতি নদী-নদী হতে কাকড়া ধরা হয়। সুন্দরবনে অক্টোবর হতে ফেব্র“য়ারী মাসে শীত মৌসুমে কাঁকড়া ধরা হয়। সুন্দরবন হতে বছরে পাঁচ মাস কাকড়া আহরণ করা হয়। ভরা গুন কাকড়া ধরার উপযুক্ত সময়। নদীর ভাংগন কুল অথবা নদী বা খালের মোহনায় কাকড়া বেশি পাওয়া যায়। সকাল ৮টা হতে বিকেল ৪টা পর্যন্ত কাকড়া ধরার উপযুক্ত সময়। দড়ি বরশি পাতার ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘন্টা পর বরশি তোলা হয়। জাল এমন ভাবে পাতা হয় যাতে মাটির তলদেশ স্পর্শ করে। হাত দিয়ে জাল টেনে তোলা হয়। যে ক্ষরশিতে কাকড়া থাকে তা ৯ ইঞ্চি পানির নীচে থাকতে বগী জালে করে নৌকায় রাখা হয়। দড়ি বরশি টেনে টেনে নৌকায় রাখা হয়। পুরা বরশি টানার পর আবার বরশি পাতা শুরু হয়। যে মাথায় শেষ হয়েছে সে মাথা হতে পুন: জাল পাতা শুরু করতে হবে এবং অনুরূপভাবে কাকড়া আহরণ করা হয়। প্রতি জেলে গড়ে প্রতি দিন ২৫-৩০ টি কাকড়া ধরতে পারে। প্রতি গোনে একজন জেলে ৩০ কেজি ধরতে পারে। কাকড়া ধরার পর নৌকায় লবনাক্ত পানিতে রাখা হয়। নৌকায় জেলেরা ৭ দিন পর্যন্ত কাকড়া রাখে। কাকড়া ধরার পর কাকড়া কে বিভিন্ন গ্রেডে সাজানো হয় এবং গ্রেড অনুযায়ী বিক্রয় করা হয়। গ্রেডিং করার সময় প্রথমে কাকড়াকে পুরুষ ও মহিলা হিসেবে ভাগ করা হয়। তারপর পুরুষ কাকড়াকে তিন গ্রেডে এবং মহিলা কাকড়াকেও তিন গ্রেডে সাজানো হয়। পুরুষ কাকড়া গ্রেড- ১ : যেসব কাকড়ার ওজন ৩০০ গ্রাম বা তদুউর্দ্ধে, গ্রেড-২ : যে সব কাকড়ার জন ২৫০ গ্রাম, গ্রেড-৩ : যে সব কাকড়ার ওজন ২০০ গ্রাম। মহিলা কাকড়া গ্রেড- ১ : যেসব কাকড়া ডিমওয়ালা এবং ওজন ১৮০ গ্রাম বা তদুউর্দ্ধে, গ্রেড-২ : যে সব কাকড়ার ডিম নেই কিন্তু ওজন ১৮০ গ্রাম, গ্রেড-৩ : যে সব কাকড়ার ডিম নেই কিন্তু ওজন ১৫০ গ্রাম।
.
– চলবে
No comments:
Post a Comment