Sunday, April 29, 2018

সুন্দরবনঃ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সম্পর্কে কিছু তথ্য - ১৯

সুন্দরবনের নল খাগড়া ঘাস ঃ নল খাগড়া সুন্দরবনের এক প্রকারের ঘাস। নদী ও খালের পাড়ে নল খাগড়া খুব ঘন ভাবে জন্মে। নতুন জেগে উঠা চরেও এ ঘাস প্রচুর পরিমানে জন্মে। গরাণ বনে নল খাগড়া জন্মে। তবে বাইন বনে খুব সামান্য দেখা যায়। নল খাগড়া অক্টোবর হতে নভেম্বর মাস পর্যন্ত বাওয়ালীরা সুন্দরবন হতে সংগ্রহ করে। নল খাগড়া দিয়ে ঝুড়ি, সাজি, এবং ধামা তৈরী করা হয়। একটি ডুলা তৈরী করতে প্রায় ২০ কেজি নল খাগড়া লাগে। সুন্দরবন হতে প্রচুর পরিমানে নল খাগড়া বাওয়ালীরা আহরণ করে। কয়রা, পাইকগাছা, আশাশুনিতে নল খাগড়া দিয়ে ঝুড়ি, সাজি ইত্যাদি তৈরীর জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। নল খাগড়া শুকাতে ৪-৫ দিন এবং প্রক্রিয়াজাত করতে ৭-১০ দিন সময় লাগে। নল খাগড়া দিয়ে একটা ডুলা তৈরী করতে ৪ দিন লাগবে।

সুন্দরবনের উলু ঘাস ঃ উলু ঘাসকে স্থানীয় লোকেরা খেড় বলে। সুন্দরবন হতে প্রাপ্ত উলু ঘাসকে বাধাই খেড় বলে। এ বাধাই খের খুব মজবুত ও টেকসই। সুন্দরবনে উলু ঘাস পাওয়া যায় শুস্ক স্থানে এবং উচু স্থানে। উলু ঘাস যেখানে জন্মে সে স্থান জোয়ারের পানিতে ডুবে না। সুন্দরবনের যেখানে কোন সাকসেশন নেই সেখানে উলু ঘাস জন্মে। উলু ঘাস সাধারণতঃ র্২ – র্৩ লম্ব্ াহয়। শীতকালে উলু ঘাস সংগ্রহ করা হয়। এ সময় বাওয়ালীদের উলু ঘাসের পারমিট দেয়া হয়। ৩-৫ জন বাওয়ালী ১ মাসে এক নৌকা উলু ঘাস সংগ্রহ করে। রান্না ঘর, গরু ঘর, পানের বরজ, বাস গৃহ প্রভৃতির চাল তৈরীতে উলু ঘাস ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। পানের বরজে উলু ঘাস বেশি করে ব্যবহৃত হয়। কারন এর টেকসই বেশি। এছাড়া সুন্দরবনের কচিখালী, কটকা ও নীলকমল বন্যপ্রাণী এলাকায় প্রচুর ছন উৎপন্ন হয়।

সুন্দরবনের হেতাল গাছ ঃ হেতাল সুন্দরবনের একটি অকাষ্ট বনজ সম্পদ। হেতালের চাহিদা রয়েছে স্থানীয় লোকজনের কাছে। বাওয়ালীরা সারা বছর সুন্দরবন হতে হেতাল আহরণ করে থাকে। হেতালকে আবার কখনো সুন্দরবনের আগাছাও বলা হয়। হেতাল সাধারণত নদী বা খালের পাড়ে উচু জায়গায় জন্মে। সুন্দরবনের সর্বত্র হেতাল জন্মে। কোন কোন জায়গায় বিশাল এলাকা জুড়ে হেতাল বনের বেষ্টনী দেখা যায়। হেতালগুলো খেজুর গাছের মত দেখায় এবং ফলগুলোও দেখতে খেজুর ফলের মত। তবে আকারে খেজুর গাছ ও ফল হতে ছোট। হেতাল বন কণ্টকাকীর্ন। হেতাল বনে বাঘ থাকার সম্ভাবনা বেশী। হেতালের পারমিট সারা বছর দেয়া হয়। তবে প্রতি নৌকায় ২০০ মনের উর্দ্ধে কোন পারমিট দেয়া হয় না। ২০০ মন হেতাল ১৪ দিনে সংগ্রহ করতে ৩-৪ জন বাওয়ালী প্রয়োজন হয়। ১৪ দিনের মধ্যে ৪ দিন বনে যাওয়া আসা এবং ১০ দিন প্রকৃত পক্ষে হেতাল কাটায় অতিবাহিত হয়। প্রতি বছর হেতাল সংগ্রহের জন্য ৯০০-১০০০ পারমিট দেয়া হয়। বছরে গড়ে সুন্দরবন হতে ৭ হাজার মেট্রিক টন হেতাল সংগ্রহ করা হয়। র্৫ দৈর্ঘের হেতাল গাছ কাটা হয়। র্৬, র্৭, র্৮, র্৯ বিভিন্ন দৈর্ঘের হেতাল পাওয়া যায়। হেতাল বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। ঘরের রোয়া, আদল ও পাইর হিসেবে হেতাল ব্যবহৃত হয়। সাধারণত গ্রামীণ লোকেরা গরু ঘর, রান্না ঘর, চিংড়ি ঘেরের ঘর তৈরীতে হেতাল ব্যবহার করে। ১র্২ – ১র্৫ লম্বা হেতাল ঘরের খুটি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। হেতাল এর ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। বরিশাল ও খুলনা বিভাগে হেতাল প্রচুর পরিমানে বিক্রয় হয়।

সুন্দরবনের ঘুর্নিঝড়, জলোচ্ছাস ও সিডর ঃ ঘুর্নিঝড় ও জলোচ্ছাসের আঘাতে প্রতিনিয়ত সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতি হয়। বিগত ১৪০ বছরে সুন্দরবনে কমপক্ষে ৫০ বার ঘুর্নিঝড় ও জলোচ্ছাস হয়। এর ফলে সুন্দরবনের উদ্ভিদরাজি ও বন্যপ্রাণীর প্রভুত ক্ষতি হয়েছে। প্রতি ৩ (তিন) বছর অথবা ৫ (পাঁচ) বছরে একবার সুন্দরবনে ঘুর্নিঝড় হওয়ার প্রবনতা দেখা যায়। এ ব্যাপারে একটি ধারাবাহিক বর্ননা নিম্নে প্রদান করা হলো। ১৫৫৮ খৃষ্টাব্দে সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে সুন্দরবনের উপর এক ভয়ংকর জলোচ্ছাস হয় যা পাঁচ ঘন্টা ব্যাপী স্থায়ী হয়। ১৬৮৮ খৃষ্টাব্দে সুন্দরবনের উপর দিয়ে ভীষণ ঝড় হয়। এতে সুন্দরবনের আশে পাশের প্রায় ৫০ হাজারেরও বেশী মানুষের মৃত্যু হয়। ১৭০৭ খৃষ্টাব্দে আরও একটি মারাত্বক ঝড়ে সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সেই সময় সুন্দরবনের আশে পাশের অনেক মানুষ ঘরবাড়ী ত্যাগ করে উত্তর দিকে পলায়ন করে। ১৭৩৭ খৃষ্টাব্দে সুন্দরবনে একসাথে ঝড় এবং ভৃমিকম্প হয়। তাতে সুন্দরবন ছিন্ন বিছিন্ন হয়ে যায়। সুন্দরবনের বড় বড় গাছ পালার ব্যাপক ক্ষতি হয়। প্লাবনে নদীর পানি ৪০ ফুট পর্যন্ত উঠে বলে ধারণা করা হয়। ১৮৬২ খৃষ্টাব্দের ১০ই মে সুন্দরবন অঞ্চলে প্রবল ঝড় ও ঝটিকা হয়। এই ঝড় যশোর ও খুলনা পর্যন্ত বিতৃর্ণ ছিল। ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দের মে মাসে সুন্দরবনের উপর দিয়ে যে ঝড় হয় তাতে সুন্দরবনের যথেষ্ট ক্ষতি হয়। ১৮৯৫ খৃষ্টাব্দে সুন্দরবনের উপর দিয়ে প্রচন্ড ঝড় বয়ে যায়। এই ঝড়ে বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করে। ১৯০৯ খৃষ্টাব্দের ১৭ই অক্টোবর সুন্দরবনের উপর দিয়ে এক মারাত্বক ঝড় বয়ে যায়। এই ঝড়ে বরিশাল ও খুলনা জেলায় ব্যাপক ক্ষতি হয়। ১৯১৯ খৃষ্টাব্দে ঝড়ে সুন্দরবনের অনেক ক্ষতি হয়। ১৯৬১ খৃষ্টাব্দের ৯ই মে উপকুলীয় অঞ্চলে ঝড়ে উপকুলের অপুরনীয় ক্ষতি হয়। ১৯৬৫ সালের ১১ মে আর একটি সুন্দরবনের আরও ব্যাপক ক্ষতি হয়। ১৭৩৭ খৃষ্টাব্দের ভুমিকম্পে সুন্দরবনের ভয়াবহ ক্ষতি হয়। ১৭৬২ খৃষ্টাব্দের ২রা এপ্রিল এক ভৃমিকম্পে বার্মা হতে কলিকাতা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এই ভুমিকম্পে সুন্দরবন এক প্রকার ডুবে গিয়েছিল। ১৮১০, ১৮২৯, ১৮৪২, ১৮৯৭, ১৮৫২, ১৮৮২ খৃষ্টাব্দের ভৃমিকম্পে সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এছাড়া ১৯৬০ সালের ৯ই অক্টোবর, ১৯৬০ সালের ৩০শে অক্টোবর, ১৯৬১ সালের ৯ই মে, ১৯৯১ সালে ৩০ মে, ১৯৬৩ সালের ২৮ শে মে, ১৯৬৫ সালের ১১ই এপ্রিল, ১৯৬৫ সালের ১১ই মে, ১৯৬৫ সালের ৩১শে মে, ১৯৬৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৬৬ সালের ১লা অক্টোবর, ১৯৬৭ সালের ১১ই অক্টোবর, ১৯৬৭ সালের ২৬ শে অক্টোবর, ১৯৬৮ সালের ১০ই মে, ১৯৬৯ সালে ১০ই এপ্রিল, ১৯৬৯ সালের ১৭ই এপ্রিল, ১৯৭০ সালের ৩রা মে, ১৯৭০ সালের ১০ই মে, ১৯৭০ সালের ২৩শে অক্টোবর, ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর, ১৯৮৫ সালের মে মাসে, ১৯৮৮ সালের ২৯শে নভেম্বর, ১৯৯১ সালের এপ্রিল মাসে, ১৯৯৫ সালের মে মাসে সুন্দরবনে ব্যাপক জলোচ্ছাস হয়।

বাংলাদেশের উপকুলীয় অঞ্চলে যে ঝড় ও জলোচ্ছাস হয় তা সুন্দরবনেও আঘাত হানে। সুন্দরবন এর পার্শবর্তী খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা জেলার ১৬টি উপজেলার জানমালকে ঝড় ও জলোচ্ছাস থেকে রক্ষা করে আসছে। সুন্দরবন এই অঞ্চলের মাটি, মানুষ ও স্থাপনা সমুহকে রক্ষা করে আসছে। সুন্দরবন বুক আগলে ঝড় ও জলোচ্ছাসের তান্ডবকে সহ্য করছে। সর্বশেষ ২০০৭ সালের ১৫ই নভেম্বর প্রলয়ংকারী ঘুর্নিঝড় সিডরের আঘাতে সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সিডরের আঘাতে শরনখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জের ১৮টি কম্পার্টমেন্টের ১,১০,০০০ হেক্টর বনভৃমি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। শরণখোলা রেঞ্জের অন্তর্গত সুন্দরবন পুর্ব বন্যপ্রানী অভয়ারন্য মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সিডরের পর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় সংস্থা সিডরে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা পরিদর্শন করে। ইউএনডিপি এর হিসেবে সিডরে সুন্দরবনের ২১% , ইউনেসকো এর হিসেবে ৩০%, এসপারসো এর হিসেবে ১৯% এবং বন বিভাগের রিমস ইউনিটের হিসেবে ২২% এলাকা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

সুন্দরবনের এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য বাংলাদেশ সরকার সুন্দরবন হতে মাছ ও মধু আহরণ করা ছাড়া অন্য সব সম্পদ আহরণ ২০০৭-০৮ সনের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষনা করে। যাতে এই বন প্রাকৃতিক ভাবেই নিজেকে পুনরুজ্জীবিত করে পুর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে পারে। সিডরের কারনে সুন্দরবনের পুর্বাংশ ১০ থেকে ১৫ ফুট উচু জলোচ্ছাসে নিমজ্জিত হওয়ায় ঐ অংশের গাছপালার অধিক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। ঘুর্নিঝড় সিডরের আঘাতে নদীর মোহনা এলাকায় বিভিন্ন গাছপালা বিশেষতঃ কেওড়া ও গেওয়া মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এছাড়া সুন্দরী গাছও ভেঙ্গে উপড়িয়ে পড়ে অনেক স্থানেই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ঘুর্নিঝড়ের পর কোন কোন এলাকা দেখে মনে হয়েছিল যেন ঐ স্থানের গাছের সমস্ত পাতা আগুনে পুড়ে গেছে। অনেক স্থানেই নদীর তীরবর্তী গোলপাতার ঝাড় উপড়ে যায় এবং স্রোতে ভেসে যায়। স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষন করে বন বিভাগের রিমস ইউনিট সিদ্ধান্তে আসে যে, সিডরের আঘাতে সমগ্র সুন্দরবনের ২.৪৭% এলাকা মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ , ১৫.২৩% এলাকা আংশিকভাবে এবং ৪.৪৭% এলাকা স্মাান্য ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষন বিভাগ, খুলনা এর রিপোট অনুযায়ী সিডরের আঘাতে সুন্দরবনে ৪০টি হরিণ, ১টি বাঘ, বহু বানর, পাখি, সাপ মারা গেছে। এছ্ড়াা সুন্দরবনের অভ্যন্তরে মিষ্টি পানির পুকুরগুলো লোনা পানিতে প্লাবিত হয়ে যায়। এর ফলে খাবার পানির তীব্র সংকটে বন্যপ্রাণীর বেঁচে থাকা দুরহ হয়ে পড়ে। সুন্দরবনের অভ্যন্তরে কর্মরত বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীগন এবং জেলে-বাওয়ালীগনও তীব্রভাবে খাবার পানির সংকটে পড়েন। সিডরের পরপরই বন বিভাগ অন্যান্য সরকারী সংস্থার সহায়তায় পুকুরের পানি লবনাক্ততা মুক্ত করার ব্যবস্থা করে এ সংকট থেকে উত্তরণ ঘটানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। সিডরের আঘাতে সুন্দরবনের রেঞ্জ, ষ্টেশন, টহল ফাঁড়ি ও রেষ্ট হাউসগুলোর বিভিন্ন অবকাঠামো কোন কোন স্থানে সম্পর্ণভাবে কোন কোন স্থানে আংশিকভাবে বিধ্বস্ত হয়। ওয়ারলেস যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত মোট ২০টি সংখ্যায় সুন্দরবনের ধারণা ও সম্পদের বিশালতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সীমাবদ্ধতার কারনে সকল বিষয়ে আলোচনা করা সম্ভব হয় নি। সুন্দরবন বিশাল। এই বিশালতা চোখে না দেখলে ধারণা করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের গর্ব এই সুন্দরবন। শুধু বাংলাদেশের গর্ব নয়, এই সুন্দরবন বিশ্বের গর্ব। সুন্দরবনের মত দ্বিতীয়টি আর কোথাও নেই। পরিবেশ সংরক্ষনের স্বার্থে সুন্দরবনকে সংরক্ষন করতে হবে। শুধু পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য নয়, ইতিহাসের ধারাবাহিকতা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষনের স্বার্থে সুন্দরবনের সংরক্ষনের বিকল্প কিছু নেই। সুন্দরবন এখনও টিকে আছে, তাই হয়ত আমরা এর প্রয়োজন ও গুরুত্ব বুঝতে পারছি না। যদি এমন কোন পরিস্থিতি হয় সুন্দরবন বাংলাদেশে দক্ষিণ অঞ্চল হতে নিশ্চিন্ন, তখন হয়ত বোঝা যাবে সুন্দরবন বাংলাদেশের জন্য কত প্রয়োজন ছিল।

এই সুন্দরবন নিয়ে ষড়যন্ত্রের শেষ নেই। দেশী বিদেশী সকল ধরনের ষড়যন্ত্রকারীরা বাংলাদেশের সুন্দরবন নিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এই সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। বৃহত্তর সুন্দরবনের ষাট শতাংশ বাংলাদেশের অংশ এবং চল্লিশ শতাংশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অংশ। পশ্চিমবঙ্গের যে অংশে এ সুন্দরবন সে অংশের সুন্দরবনের অবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক খারাপ। পশ্চিমবঙ্গের অংশের সুন্দরবন অনেক আগেই তার সংরক্ষিত চেহারা হারিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন এর অনেক অংশ জবর দখলদারদের কবলে। এই ধরনের চিত্র বাংলাদেশে নেই। গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের সুন্দরবনের কোন অংশ জবর দখল হয় নাই। বাংলাদেশের সুন্দরবন পাকিস্তান আমল হতে সীমিত অর্থ দ্বারা পরিচালিত হতো। জনবলও ছিল প্রয়োজনের তুলনায় সীমিত। তখন সুন্দরবন হতে প্রচুর পরিমানের বনজ দ্রব্য আহরিত হতো। সুন্দরবনে যে সকল কর্মকর্তা কর্মচারী কাজ করতো তারা বন সংরক্ষনের পাশাপাশি বনজদ্রব্য আহরনের সাথে যুক্ত ছিল। বনজদ্রব্য আহরনে বেশ কিছু বাড়তি সুবিধা বন কর্মচারী কর্মকর্তারা পেত। এই সকল সুযোগ সুবিধা পাওয়ায় তারা শত কষ্টের মধ্যে সুন্দরবনে থেকে কাজ করতো। সুন্দরবন সংরক্ষনে ও প্রশাসনিক কাজ-কর্ম চালাতে যে অর্থের প্রয়োজন হতো সে অর্থ সরকারী ভাবে বরাদ্দ না করলেও তেমন কোন সমস্যা হতো না। কর্মচারী কর্মকর্তারা যে সকল সুযোগ সুবিধা পেত তা থেকে বন সংরক্ষনের প্রশাসনিক কাজে প্রয়োজনীয়া অর্থ জোগান দেয়া হতো। এটি এক ধরনের অন্যায়।

বাংলাদেশ হওয়ার পরও এ ধারা অব্যাহত থাকে। এর কারনে সুন্দরবন সংরক্ষন ও উন্নয়নে যে পরিমান অর্থের প্রয়োজন যে পরিমান অর্থের বরাদ্দ ছিল না। বর্তমানে সুন্দরবন হতে বনজদ্রব্য আহরণ কমে গেছে। বাড়তি তেমন কোন সুযোগ সবিধা নেই। সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। সৃতরাং সুন্দরবন সংরক্ষণে বিষয়টি চিন্তা করা অত্যন্ত জরুরী। বনাভ্যন্তরে অবস্থিত যে কোন ক্যাম্পে জনবল প্রেরনের পুর্বেই সেখানে নিম্নবর্নিত কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। যেমনঃ পানিয় জলের জন্য গভীর নলকুপের ব্যবস্থা করা, পর্যাপ্ত আলোর জন্য সৌর শক্তি এবং জেনারেটর এর ব্যবস্থা করা, ক্যাম্প এলাকায় যাতে জোয়ার ভাটার পানি প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় বাধ নির্মাণ করা, বন্য প্রাণীর আক্রমন হতে আত্বরক্ষার জন্য বাধের ওপর অত্যন্ত মজবুত লোহার বেড়া স্থাপন করা ,মিষ্টি পানির পুকুর খনন করা, কর্মকর্তা কর্মচারীদের অবস্থানের জন্য পাকা ইমারত নির্মান করা। বন বিভাগ গ্রাম বাসীদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের স্বার্থে বিভিন্ন কর্মসূচী বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। যেমনঃ সেচ সুবিধা বৃদ্ধির জন্য খাল খনন করা, মিষ্টি পানি সরবরাহের জন্য পুকুর খনন করা, রাস্তা ঘাট নির্মান করা, সৌর শক্তির সাহায্যে গ্রামের রাস্তায় আলোর ব্যবস্থা করা। গ্রামবাসীর চিকিৎসার জন্য নিয়মিত মেডিকেল টিম এর ব্যবস্থা করা, সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামের সুরক্ষার জন্য বাধ নির্মান করা, গ্রামীন জনগোষ্টির পেশায় প্রশিক্ষন প্রদানের ব্যবস্থা করা,সুন্দরবনের উন্নয়ন ও সংরক্ষনে অনেক মানুষ অনেক বুদ্ধি ও পরামর্শ দিতে পারে এবং দিয়েও থাকে। কিন্তু বাস্তবে তারা কেউ সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসে না। বিশেষ করে শীত মৌসুমে প্রচুর ভি,আই,পি সুন্দরবন পরিদর্শনে আসেন। তারা সুন্দরবনে অবন্থান করেন তখন তারা বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ ও আশ্বাস দেন। কিন্তু ফিরে যেয়ে সব ভুলে যায়। সুন্দরবন থেকে মাছ, মধু, শুটকি নেয় সকলেই। সকলেই এর রূপ ও সৌন্দর্য উপভোগ করে। সুন্দরবন তার রূপ সৌন্দর্য ও সামগ্রী সকলকেই বিলিয়ে দেয়। কিন্তু সে কি পায়? এ প্রশ্নের সমাধান খোজা জরুরী।

একটি কথা আমাদের বিশেষভাবে স্মরণ রাখা দরকার যে সুন্দরবন সংরক্ষনের সাথে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নটি জড়িত। সুন্দরবন জীবন্ত বিশাল সম্পদের ভান্ডার। এই বিশাল ভান্ডারকে কাজে লাগাতে হবে। শুধুমাত্র সুন্দরবনে ইকোট্যুরিজ্যমের ব্যবস্থা করে আয় করা যায় শত শত কোটি টাকা। পরিকল্পনা অনুযায়ী বনজদ্রব্য আহরণ ও ইকোট্যুরিজমের খাত হতে পারে বিশাল অংকের টাকা যা শুধুমাত্র সুন্দরবন উন্নয়নের কাজে আসবেনা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরাট সহ্য়াক ভৃমিকা পালন করবে। সবচেয়ে বড় কথা সুন্দরবন সংরক্ষণে সুন্দরবন সংলগ্নবাসীদের দরদ থাকতে হবে। তাদের দরদ এবং মায়া থাকলে সুন্দরবনের মধ্যে কাঠচোর, সন্ত্রাসীদের রাজত্ব সহজে হতে পারে না। সুন্দরবন নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার এখনই সময়। বর্তমানে এক ক্রান্তিকালের মধ্যে দিয়ে সুন্দরবনের কাজ কর্ম চলছে। যদি সুন্দরবনের সঠিক সংরক্ষন ও উন্নয়ন না হয় তবে এমন দিন আসবে যখন সুন্দরবন তার রূপ সৌন্দর্য হারাবে এবং এর কারনে বাংলাদেশে নেমে আসবে অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত বিপর্যয়।

সমাপ্ত।

No comments:

Post a Comment

Follow Us @VisitSundaebon