Monday, April 30, 2018

জীববৈচিত্রে সমৃদ্ধ বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের পাশেই যেন আরেক সুন্দরবন! প্রকৃতির নিয়মে সেটিকে আরো সুশোভিত করে তুলছে প্রাণিকুল। আসল সুন্দরবন ছেড়ে  সেখানে গিয়ে যেন আত্মীয় বাড়ি বেড়ানোর সুখ উপভোগ করছে তারা। সুন্দরবনের আকার বৃদ্ধি হয়ে হিরণ পয়েন্ট ও দুবলার চরের মাঝখানে জেগে ওঠা এই অঞ্চলটি সবার কাছে পরিচিতি পেয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু চর’ নামে।শুরুতে ফাঁকা থাকলেও এখন চরে অনেক গাছ-গাছালি জন্মেছে। সুন্দরবন থেকে হরিণ, শূকর, বানর ছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির সাপ সেখানে আবাস গেড়েছে।
জানা গেছে, প্রায় দুই যুগ আগে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে গিয়ে নতুন জেগে ওঠা চরের দেখা পান মৎস্যজীবী মালেক ফরাজি। ফিরে এসে তিনিই জনমানবহীন দ্বীপের নাম রাখেন ‘বঙ্গবন্ধু চর’।এরপর ১৯৯২ সালে অন্যান্য জেলেরাও দ্বীপটিতে যান। তখন এর আয়তন ছিল মাত্র দুই একর, বালি আর কাদায় ভরা। ২০০৪ সালের পর থেকেই দ্বীপটি বড় হতে থাকে। চলতি বছর দ্বীপটির আয়তন দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৮৪ বর্গকিলোমিটার।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের হিরণ পয়েন্ট থেকে ১৫ কিলোমিটার এবং দুবলারচর থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ‘বঙ্গবন্ধু চরের’ অবস্থান। চরটি সুন্দরবনের বন্যপ্রাণিদের অভয়ারণ্য (দক্ষিণ) এবং ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের মধ্যে পড়েছে। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু চরে কেওড়া, বাইন, সুন্দরি ও গরান প্রজাতির ম্যানগ্রোভ বৃক্ষ এবং লতাগুল্ম জন্মেছে।চরটি আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বন্যপ্রাণির অভয়াশ্রম এলাকা নীলকমলের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যাবে। বর্তমানে ভাটার সময় ওই দুই এলাকার মধ্যে ব্যবধান হয়ে রয়েছে ছোট্ট একটি খাল।
বঙ্গবন্ধু দ্বীপের বিষয়ে মোংলার চিলা ইউনিয়নের জেলে সরদার এবং দুবলার চরের মৎস্য ব্যবসায়ী মো. বেলায়েত হোসেন (৩৬) জানান, বর্তমানে চরটি হিরণ পয়েন্টের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। এজন্য ভাটা এলে সুন্দরবনের অনেক প্রাণি সাঁতার কেটে ওই চরে পাড়ি জমাচ্ছে। প্রায় ২০ বছর ধরে বেলায়েত সুন্দরবন এলাকায় ব্যবসা করছেন। বছরে ৪/৫ বার তার চরে যাওয়া পড়ে।বেলায়েতের ভাষায়, চরটি যেন সুন্দরবনের ভেতরে আরেক সুবিশাল সুন্দরবন, দেখতে ছবির মতো।
এ বিষয়ে সুন্দরবন খুলনা রেঞ্জের সিএফ আমির হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু চরে দিনকে দিন ইকো-ট্যুরিস্টদের পদচারণা বাড়ছে। তবে সেখানে কোনো পর্যটন স্পট করার পরিকল্পনা আপাতত বনবিভাগের নেই। চরটির পাশেই বিশ্ব ঐতিহ্য নীলকমল অভয়ারণ্য। এটি ন্যাচারাল ফরেস্ট, তাই এটিকে সংরক্ষণ করাই আমাদের কাজ।’ তবে আশঙ্কার বিষয় হলো, ২০১৫ সালে কোস্টগার্ড দ্বীপটির নাম ‘সরোয়ার স্যান্ড দ্বীপ’ উল্লেখ করে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার স্থাপনের অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসনে চিঠি দিয়েছে।এতে বলা হয়েছে, বঙ্গোপসাগরে চলাচলকারী নৌযান ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লাবাহী জাহাজের নিরাপত্তা দিতে পর্যবেক্ষণ টাওয়ারটি বসানো প্রয়োজন।এছাড়া চরের জমি চেয়ে ভূমি এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও পৃথক আবেদন করেছে কোস্টগার্ড। বঙ্গবন্ধু চরে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার বসালে সেটি জীববৈচিত্রের ওপর সরাসরি প্রভাব পড়বে।
তবে মোংলা কোস্টগার্ডের অপারেশন কর্মকর্তা লে. কমান্ডার ফরিদুজ্জামান বলেন, ‘টাওয়ারটি নির্মাণ হলে মোংলা ও পায়রা বন্দরে দেশি-বিদেশি জাহাজের নিরাপত্তা মনিটরিং করা সহজ হবে।’জেলেরা দুই যুগ আগে দ্বীপটি খুঁজে পেলেও ১৯৭৬ সাল থেকেই স্যাটেলাইট ইমেজে এর অস্তিত্ব ধরে পড়ে। এরপর দ্বীপটি মাঝেমধ্যে জেগে ওঠে, আবার ডুবে যায়। তবে ২০০৪ সাল থেকে দ্বীপের আকার ধীরে ধীরে স্থিতিশীল অবস্থায় আসতে থাকে। এখন  ক্রমেই বড় হচ্ছে এটি।চলতি বছরের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৯ সদস্যের গবেষক দল বঙ্গবন্ধু চরে গিয়ে তিন দিন অবস্থান করে। এ সময় তারা দ্বীপের অভ্যন্তরীণ মৃত্তিকা, ডিসিপি জরিপ ও ভিজিবিলিটি অ্যানালাইসিসসহ বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞানভিত্তিক অনুসন্ধান চালান।
প্রতিনিধি দলের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘জেগে উঠার পর থেকে কয়েক গুন বৃদ্ধি পেয়েছে বঙ্গবন্ধু দ্বীপের আয়তন। গেল এক যুগে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে।আমরা প্রায় ১৪ মিটার গভীর একটি ড্রিল করে এর অভ্যন্তরীণ মৃত্তিকা সংগ্রহ করেছি। তাতে দেখা গেছে, সমুদ্র তলদেশ থেকে চারটি পর্যায়ে দ্বীপটি গঠিত হয়েছে। বর্তমানে তা ধীরে ধীরে পূর্ণতা লাভ করছে।’ বাগেরহাটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘দ্বীপটি দেশের স্বার্থে কীভাবে ব্যবহার করা যায়, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’

সুন্দরবন হবে আরো সুন্দর!
সুন্দরবন নিয়ে বিস্তর কথা হচ্ছে, লেখালেখি হচ্ছে। সেটা দীর্ঘদিন ধরেই। সুন্দরবনের পাশে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে সবারই সুন্দর সুন্দর কথা বলার কথা ছিল। কিন্তু সবাই সুন্দরবন নিয়ে বেশি বেশি অসুন্দর কথা বলছেন। এটা মোটেও ঠিক নয়।
এক্ষেত্রে একমাত্র দায়িত্ব নিয়ে সুন্দর সুন্দর কথা বলার কাজটি করে চলেছে সরকার ও তার দায়িত্বশীল মন্ত্রণালয়। শুধু তাই নয়, সুন্দরবনকে সুন্দর করার যতো আয়োজন বর্তমান সরকারই সেটা নিজ দায়িত্বেই করে চলেছে। দেশের গণমাধ্যমও ‘সুন্দরবন ধ্বংস! সুন্দরবন ধ্বংস’ এসব না বলে চুপ থেকে চরম দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিচ্ছে।
সারাদেশের মতো সুন্দরবনেও বিদ্যুৎ সরবরাহ সময়ের দাবি। শুধু মানুষই বিদ্যুতের আলোয় থাকবে, এটা ঠিক নয়। বনের পশুপাখিরও আছে বন আলোকিত করে রাতের আঁধার কাটানোর অধিকার। এটা একটা যুক্তি। আবার অনেকে বলছেন, মাত্র ৯-১০ কিলোমিটার দূরত্বের রামপালে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র খুব বেশি কাছে হয়ে যায়। এটা বনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এটা প্রতিবেশ ঝুঁকিতে ফেলবে বন ও তার জীবজন্তু ও প্রাণীদেরকে। এক পর্যায়ে খাদ্যশৃঙ্খল নষ্ট হয়ে বন ও তার বাসিন্দারা ধ্বংস হয়ে যাবে।
বলি, একটি দেশের জন্য বনজঙ্গলের দরকারটাইবা কি? বনজঙ্গলে কি হয়? আমরা প্রাচীন ইতিহাসে পড়েছি, মানুষ উল্টো বনজঙ্গল কেটে মানব বসতি গড়ে সভ্যতা বিনির্মান করেছে। সুন্দরবনে মানববসতি গড়ে তোলা সময়ের দাবি। কয়েকদিন আগেই ঘোষণা হলো, দেশের জনসংখ্যা এখন নাকি ষোলো কোটি হয়েছে। এই ষোলো কোটি মানুষের দেশে বন উজাড় করে বসতি গড়ার দরকার আছে। এতো মানুষের জন্য আবাসন একটা বড় সমস্যা।
সুন্দরবন সাফ করে এর প্রক্রিয়া শুরু করা যেতে পারে। এ জন্য বনের বাসিন্দাদের উচ্ছেদ প্রয়োজন। কিন্তু হুটহাট করে বনের বাঘ, মোষ, সাপ, ব্যাঙ, কুমির, গুইসাপ, হরিণদেরকে উচ্ছেদ করলে বড়ই অমানবিক দেখায় বিষয়টা। আপনারা দেখেছেন, শহরের বস্তি উচ্ছেদ করলে তার বাসিন্দাদের কি দুর্দশাটাই না হয়। এক্ষেত্রে সুন্দরবনের ব্যাপারে দুর্দান্ত দূরদর্শী এক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র হলো সেই আধুনিক পদ্ধতি। এর বাসিন্দারা বসতিচ্যূত হবেন আগামি ৪০ বা ৫০ বছরে ধীরে ধীরে। সুন্দর এক উচ্ছেদ ব্যবস্থা।   
সরকারের পরিবেশ সমীক্ষা অনুযায়ী, রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলে প্রতিদিন ১৪২ টন বিষাক্ত সালফার ডাই অক্সাইড, ৮৫ টন বিষাক্ত নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড নির্গত হবে। বছরে ৯ লাখ টন অত্যন্ত ক্ষতিকর বিষাক্ত ছাই বাতাসে মিশবে। কয়লাবিদ্যুৎ প্লান্টের জন্য রামপালের পাশের পশুর নদী থেকে পানি তুলতে হবে, গরম পানি ফেলতে হবে।
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। এভাবেই নদীর পানি, জলজ জীববৈচিত্র্যের গোষ্ঠি নিপাত হবে। এভাবেই ওই এলাকা মানুষের বসবাসের উপযোগি করা হবে।
বিদ্যুতও পেলাম, সুন্দরবন থেকে ক্ষতিকর ও ভয়ানক সব জীবজন্তুর হাত থেকে মানবজাতি বিশেষ করে উপকূলীয় লোকজনকেও রক্ষা করলাম, এরকম একটা সুন্দর প্রকল্পের বিরোধিতা করা শুধু দেশদ্রোহীতাই নয়, রীতিমত মীরজাফরিও বটে। বাংলাদেশের মিডিয়া এ ক্ষেত্রে ভীষণ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিচ্ছে। তারা অর্জুন রামপালদের নিয়ে যতো নিউজ প্রকাশ করছে এখন, তারচে কম প্রকাশ করছে সুন্দরবনের রামপাল প্রকল্প নিয়ে খবর। এখানেই দায়িত্বশীলতার বড় পরিচয়।
এই বাংলাদেশের বাইরে অন্য কোনোদেশে এই রামপাল প্রকল্প হলে দেখা যেতো মিডিয়া প্রতিদিনই ‘রামপাল রামপাল করে’ মাথা নষ্ট করে ফেলতো। সাপ-ব্যাঙ-কুমির-বাঘের অভয়ারণ্যের জন্য তারা ঘুম হারাম করে ফেলত। কিন্তু আমাদের মিডিয়া এটা সুন্দরভাবে বুঝতে পেরেছে। তাই তারা ক্ষতিকর বাঘ-কুমির, সাপ-ব্যাঙ-গুইসাপদের পক্ষে নেই।
উল্লেখ্য, ২০০ বছর আগেও সুন্দরবনের মোট আয়তন ছিল প্রায় ১৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার। বর্তমানে সমাজহিতৈষী নানা সরকার ও স্থানীয় প্রভাবশালী ভাল মানুষদের তৎপরতায় এটা দাঁড়িয়েছে এখন ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটারে। আগামি ৫০ বছরে এটিকে ঐতিহাসিক ৭১ বর্গ কিলোমিটারে নিয়ে আসা হবে। তখন সুন্দরবন হয়ে যাবে কিউট সাইজের এক সাফারি পার্ক।
যেহেতু আধুনিক মানুষদের কাছে বনের চেয়ে সাফারি পার্কের কদর বেশি, ফলে দেশের লোকজন তখন সুন্দরবন সাফারি পার্কের ভেতর দিয়ে গিয়ে একেবারে সমুদ্রের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে সাগরের সাথে সেলফি তুলতে পারবেন। নয়নাভিরাম সূর্যাস্ত দৃশ্য দেখে তখন বলে উঠতে পারবেন, ‘ওয়াও! বহুত আচ্ছা হ্যায়। কুল হ্যায়।’
লুৎফর রহমান হিমেল : সাংবাদিক, কলামিস্ট। বার্তা সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

Sunday, April 29, 2018

সুন্দরবন আমাদের গর্ব। প্রাকৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ এটি। কিন্তু আপনি কি কখনো ভেবেছেন এর নাম সুন্দরবন কেন? বনটি সুন্দর, তাই? নাকি সুন্দরী গাছের জন্য? এ নিয়ে আছে নানান মত। অনেকে মনে করেন, নামটির আক্ষরিক শব্দেই রয়েছে মূল কথা। সুন্দরবন অর্থ সুন্দর জঙ্গল বা সুন্দর বনভূমি। আর আমাদের সুন্দরবনের সৌন্দর্য্য যে অতুলনীয় তা তো বলারই অপেক্ষা রাখে না।
 
সুন্দরবন নামের সম্ভাব্য আরেকটি কারণ মনে করা হয় সমুদ্রকে। সমুদ্রের তীরে বনের অবস্থান বলে 'সমুদ্র বন' থেকে কালক্রমে এর নাম হয়েছে সুন্দরবন এমনটি ধারণা করেন অনেকে।
 
তবে বিশাল এক জনমত আছে সুন্দরী গাছের পক্ষে। এই বনে অসংখ্য সুন্দরী গাছ জন্মে। বনের স্থানীয়দের ঘর তৈরি, ঘরের ছাউনি দেওয়ার গাছে এই গাছের বড় বড় পাতা খুবই কাজে দেয়। শুধু তাই নয়, এখানকার বিখ্যাত সুন্দরী গাছের মূলে রয়েছে ডায়াবেটিস প্রতিরোধী ওষুধ। স্থানীদের জোরালো যুক্তি, এই বনের নামের সাথে জড়িত সুন্দরী গাছই।
 
তবে নামের রহস্য যাই হোক না কেন সুন্দরবন ভ্রমণ এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। সুন্দরবনকে জালের মত জড়িয়ে রয়েছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, কাদা চর এবং ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবণাক্ততাসহ ক্ষুদ্রায়তন দ্বীপমালা।
 
মোট বনভূমির ৩১.১ শতাংশ, অর্থাৎ ১,৮৭৪ বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে নদীনালা, খাঁড়ি, বিল মিলিয়ে জলাকীর্ণ অঞ্চল। বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল হলেও বাঘ মামার দেখা পাওয়া খুবই কঠিন। তবে দেখা পাবেন হরিণ, বানরসহ নানান বণ্য প্রাণীর। অসংখ্য পাখির কলকাকলি আর পাতার ফাঁকে বয়ে চলা বাতাসের শব্দ সত্যিই রোমাঞ্চকর। একবার হলেও অবশ্যই ভ্রমণ করবেন অপরূপ এই বনটি।
সল্প খরচে এবং একদিনেই যারা সুন্দরবন ভ্রমণ করতে চান তাদের জন্য একটি আদর্শ দর্শনীয় স্থান ‘করমজল’ ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্র।
সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের অধীন করমজল পর্যটন কেন্দ্রটি ভ্রমন পিপাসুদের কাছে একটি আকর্ষণীয় স্থান। ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্র ছাড়াও এখানে রয়েছে হরিণ ও কুমির প্রজনন ও লালন পালন কেন্দ্র।
বাগেরহাটের মংলা উপজেলা সদর বা মংলা বন্দর থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় চড়ে করমজলের জেটিতে পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র এক থেকে দেড় ঘণ্টা। নদী পথে মংলা থেকে দূরত্ব প্রায় ৮ কিলোমিটার আর খুলনা থেকে প্রায় ৬০ কি.মি.।
KoromJolএখানে প্রবেশপথেই মাটিতে শোয়ানো বিশালাকৃতির মানচিত্র সুন্দরবন সম্পর্কে সাম্যক ধারণা দেবে। মানচিত্রটিকে পেছনে ফেলে বনের মধ্যে দক্ষিণে চলে গেছে আঁকাবাঁকা কাঠের তৈরি হাঁটা পথ। এই নাম ‘মাঙ্কি ট্রেইল’।
এই নামের স্বার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায় ট্রেইলে পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই। পুরো ট্রেইল জুড়েই দেখা মিলবে সুন্দরবনের অন্যতম বাসিন্দা রেসাস বানরের। বানরগুলো ট্যুরিস্টদের কাছাকাছি চলে আসে। হাতে কলা বা অন্য কোনো খাবার নিয়ে পথ না চলাই ভালো। কারণ বানরগুলো খাবারের জন্য আপনাকে ঘিরে ধরতে পারে। তাই সাবধান বানর থেকে।
karamjal-Sundarban-Pic-003কাঠ বিছানো পথের দুই ধারে ঘন জঙ্গল। দুই পাশে বাইন, কেওড়া আর সুন্দরী গাছের সারি। তবে বাইন গাছের সংখ্যা বেশি। কাঠের পথটি কিছু দূর যাওয়ার পর হাতের বাঁয়ে শাখা পথ গিয়ে থেমেছে পশুরের তীরে। শেষ মাথায় নদীর তীরে বেঞ্চ পাতানো ছাউনি। মূল পথটি আরও প্রায় আধা কিলোমিটার দক্ষিণে গিয়ে ছোট খালের পাড়ে থেমেছে।
এ পথের মাথায় গোলপাতার ছাউনির গোলাকৃতির আরও একটি শেইড। যেখানে বেঞ্চে বসে বনের নিস্তব্ধতা উপভোগ করা যাবে।
সেখান থেকে আবারও পশ্চিম দিকে কাঠের ট্রেইলটি চলে গেছে কুমির প্রজনন কেন্দ্রের পাশে। এই ট্রেইলের মাঝামাঝি জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার (বুরুজ)।  করমজলে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে একটি সুউচ্চ ওয়াচ টাওয়ার। এর চূড়ায় থেকে করমজল এবং চারপাশটা ভালো করে দেখা যায়।
KaromJol-Pic-002সুন্দরবনের উপরিভাগের সবুজাভ নয়নাভিরাম এ দৃশ্য দেখে যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য।
কাঠের তৈরি ট্রেইলের একেবারে শেষ প্রান্তে কুমির প্রজনন কেন্দ্র। সেখান থেকে সামান্য পশ্চিম দিকে হরিণ ও কুমিরের প্রজনন কেন্দ্র। সামনেই ছোট ছোট অনেকগুলো চৌবাচ্চা। কোনটিতে ডিম ফুটে বের হওয়া কুমির ছানা, কোনটিতে মাঝারি আকৃতির আবার কোনটিতে আরও একটু বড় বয়সের লোনা জলের কুমিরের বাচ্চা।
একেবারে দক্ষিণ পাশে দেয়াল ঘেরা বড় পুকুরে আছে রোমিও, জুলিয়েট আর পিলপিল। লবণ পানির প্রজাতির কুমিরের প্রজনন বৃদ্ধি ও লালন-পালনের জন্য সুন্দরবনস বায়োডাইভার্সিটি কনজারভেশন প্রকল্পের আওতায় ২০০২ সালে পূর্ব সুন্দরবনের করমজল পর্যটন কেন্দ্রে ৮ একর জমির ওপর বনবিভাগের উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় দেশের একমাত্র সরকারি এই কুমির প্রজনন কেন্দ্র।
Crocodile-in-Sundorbonওই বছর সুন্দরবনের বিভিন্ন নদীতে জেলেদের জালে আটকা পড়া ছোট-বড় পাঁচটি লোনা পানির কুমির নিয়ে কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হয়। রোমিও-জুলিয়েটের বয়স এখন ২৪। এই জুটি প্রজননক্ষম হয় ২০০৫ সালে।
জুলিয়েট আকারে রোমিওর চেয়ে সামান্য ছোট। লোনা পানির এই প্রজাতির কুমির ৮০ থেকে ১০০ বছর বাঁচে। এই কেন্দ্রটি তত্ত্বাবধানে ছিলেন (২০১৪ সাল) অষ্ট্রেলিয়ার আন্তর্জাতিক ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সেন্টারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এক জন বন কর্মকর্তা।
CROCODILE-in-SundorBonজুলিয়েট এ পর্যন্ত (মে ২০১৫) ডিম দিয়েছে মোট ৫৩২টি। সেখান থেকে ২৮৪টি (ডিসেম্বর ২০১৪) বাচ্চা ফুটিয়েছেন বন্য প্রাণী প্রজনন ও সংরক্ষণ কেন্দ্রের কর্মীরা। করমজল বন্য প্রাণী প্রজনন ও সংরক্ষণ কেন্দ্রের আরেক নারী সদস্য পিলপিল। এখন পর্যন্ত সে ডিম দিয়েছে ৪৪টি, যা থেকে বাচ্চা ফুটেছে ৩৩টি।
এর পাশেই চোখে পড়বে চিড়িয়াখানার মতো উপরিভাগ উন্মুক্ত খাচায় ঘেরা খোলা জায়গা। ভেতরে চিত্রা হরিণ। খাঁচার ভেতরে পশ্চিম কোণে ছোট আরেকটি খাঁচা। ভেতরে রয়েছে কয়েকটি রেসাস বানর।
সাম্প্রতি (২০১৫ সালে) আই.ইউ.সি.এন (IUCN) প্রকল্পের আওতায় বাচ্চা উৎপাদনের উদ্যেশ্যে ‘করমজল বন্য প্রাণী প্রজনন কেন্দ্রে’র পুকুরে  ছাড়া হয়েছে ছাড়া হয়েছে ১৪টি কচ্ছপ।
  • প্রয়োজনীয় তথ্য
করমজলে দেশি পর্যটকের জন্য প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি ২০ টাকা, বিদেশী পর্যটক ৩শ’ টাকা। দেশি ছাত্র ২০ টাকা। দেশি গবেষক ৪০ টাকা। বিদেশী গবেষক জনপ্রতি ৫শ’ টাকা। অপ্রাপ্ত বয়স্ক (বারো বছরের নিচে) ১০ টাকা। দেশি পর্যটকের ভিডিও ক্যামেরা ব্যবহারে ক্যামেরা প্রতি ২শ’ টাকা। বিদেশি পর্যটক ৩শ’ টাকা। সব মূল্যের সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রযোজ্য।
karamjal-Sundarban-Pic-02করমজল যেতে হয় পশুর নদী পাড়ি দিয়ে। এই নদী সবসময়ই কম-বেশি উত্তাল থাকে। তাই ভালো মানের ইঞ্জিন নৌকা নিয়ে যাওয়া উচিৎ। আগেই নিশ্চিত হয়ে নিন নৌকায় পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট ও লাইফ বয়া আছে কী না।
বন রক্ষী ছাড়া জঙ্গলের ভেতরে ঢুকবেন না। হরিণ ও কুমির প্রজনন কেন্দ্রের কোন প্রাণীকে খাবার দিবেন না।
  • কীভাবে যাবেন
সুন্দরবনের ‘করমজল’ ইকো-ট্যুরিজম (পর্যটন) কেন্দ্রে যাবার জন্য সব চেয়ে সহজ মংলা থেকে নদী পথে যাওয়া। এছাড়া খুলনা থেকেও নদী পথে যেতে পারেন করমজল। দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে সড়ক পথে আপনি আসতে পারবেন বাগেরহাটের মংলায়। মংলা থেকে ইঞ্জিন নৌকায় চড়ে যেতে হবে করমজল।
KoromZol-Sundorbonদশ জনের উপযোগী একটি ইঞ্জিন নৌকার যাওয়া আসার ভাড়া পড়বে ৭শ’ (৭০০) থেকে ১ হাজার ২শ’ টাকা। এসব ইঞ্জিন নৌকাগুলো সাধারণত ছাড়ে মংলা ফেরি ঘাট থেকে।
  • কোথায় থাকবেন
সারাদিন করমজলে বেড়িয়ে রাতে এসে থাকতে পারেন বন্দর শহর মংলায়। এখানে আছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মোটেল পশুর (০৪৬৬২-৭৫১০০) ছাড়াও বেশ কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি রেস্ট হাউস হোটেল-মোটেল। রুম (ডাবল) প্রতি ভাড়া পড়বে ৮শ’ থেকে ২ হাজার টাকা (নন এসি/এসি)।
ইকনোমি বেড ৬শ’ টাকা। এছাড়াও মংলা শহরে সাধারণ মানের কিছু হোটেল আছে। এসব হোটেলে দেড়শ’ থেকে ৬শ’ টাকায় কক্ষ পাওয়া যাবে।
সুন্দরবনের করমজল প্রজনন কেন্দ্র, পিপাসু মেধার অজানা তথ্য। বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের বন্যপ্রাণি ইকোট্যুরিস্ট করমজলে প্রজনন কেন্দ্রের বানর-হরিণ, কচ্ছপ ও কুমিরসহ প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মুগ্ধ দর্শনার্থীরা। বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের করমজল দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে। এই স্থানটিতে দর্শনার্থীদের ভিড় থাকে চোখে পড়ার মত।
সুন্দরবনের করমজল প্রজনন কেন্দ্র, পিপাসু মেধার অজানা তথ্য
আত্মীয় স্বজন ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সুন্দরবনের করমজলে এই পর্যটন মৌসুমে এলাকাটি ঘুরে আনন্দ-উপভোগ করছেন। সুন্দরবন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, করমজলে হরিণ ও কুমির প্রজনন কেন্দ্রে যদি ডলফিনের প্রদর্শনি করা সম্ভব হয় এবং বনে যেসব অরকিড আছে সেগুলোর বাটার ফ্লাইয়ের গার্ডেন করে একটু বৈচিত্র্য আনতে পারলে আরও দর্শানার্থী বাড়বে।
সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া পলিটেকনিকেলের শিক্ষার্র্থী আব্দুল মমিন বলেন, আমরা ৪৬ জনের একটি টিম আসছি। বইতে পড়েছি সুন্দরবন সম্পর্কে, কিন্ত আজ স্বচক্ষে দেখে খুবই ভাল লেগেছে। এখানকার প্রাকৃতিক বনের সৌদর্য আলদা বৈশিষ্টের, না দেখলে বুঝানো যাবে না। অনেক কিছু দেখলাম, অনেক মজা করেছি।
ফরিদপুর থেকে আসা গৃহবধূ তায়শা ইসলাম বলেন, সুন্দরবনে প্রথম এসে হরিন, বানর, কুমির, বিলুপ্ত প্রজাতির কচ্ছপ ও নানা পশুপাখি দেখে মুগ্ধ হয়েছি। যারা সুন্দরবনে আসেননি, তারা সুন্দরবন ঘুরে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন। এই বনের আলাদা বৈশিষ্ট রয়েছে।
সুন্দরবনের করমজল প্রজনন কেন্দ্র
তবে অনেক দর্শনার্থীদের অভিযোগ, ট্যুরিজম এলাকায় দর্শনার্থীদের বসার টুলের ব্যবস্থা নেই, ফুট ট্রেইল ও ওয়াচ টাওয়ারটি নাজুক। একারণে দর্শনার্থীদের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হয়। এখানে অবকাঠামোর উন্নত ব্যবস্থা থাকলে দর্শনার্থীরা ভালোভাবে সুন্দরবন ঘুরে দেখতে পারতো।
বাগেরহাটের মোংলা বন্দর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে পূর্ব সুন্দরবনের করমজলে বন্যপ্রাণি ইকোট্যুরিজম সেন্টার হওয়ায় প্রতিনিয়ত দেশ-বিদেশের প্রতিবেশ পর্যটকরা আসছে নৈসর্গ উপভোগ করতে। সুন্দবনের বানর, হরিণ ও কুমিরসহ পশু-পাখি খুব কাছ থেকে দেখা ও স্পর্শ করা যায়। এছাড়া বনের সৌন্দার্য দেখার জন্য রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। একারণে সহসাই বনের দৃশ্যগুলো দেখে দর্শনার্থীর মুগ্ধ। অনেক দর্শনার্থীরা বনের অবিরাম দৃশ্যগুলো ধারন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
সুন্দরবনের করমজল প্রজনন কেন্দ্র, পিপাসু মেধার অজানা তথ্য
কিছু সমস্যার কথা স্বীকার করে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের করমজল বন্যপ্রানী ইকোট্যুরিজমের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, এসএসসির পরীক্ষা শেষ হওয়ায় দর্শনার্থীদের সংখ্যা বাড়ছে। শুক্রবার দর্শানর্থীদের সামাল দিতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়েছে। পর্যটক মৌসুমে এখানে দুটি ঘাট যথেষ্ট নয়। আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে নতুন কিছু অবকাঠামো নির্মানের। যাতে ঘুরতে এসে কোন দর্শনার্থীদের বিড়ম্বনায় পড়তে না হয়।

বাংলাদেশের জাতীয় পশুর নাম কী? উত্তর – রয়েল বেঙ্গল টাইগার। কোথায় দেখা যায় রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে? উত্তর – সুন্দরবনে। কেন সুন্দরবন ? সে বনে সুন্দরী গাছের উপস্থিতির কারণে। সেখানে আর কী পাওয়া যায়? মধু পাওয়া যায়। আসলে  সুন্দরবনে কী পাওয়া যায় না-এটা একটা প্রশ্ন হতে পারে! আসুন জেনে নেওয়া যাক অজানা তথ্যের ভাণ্ডার প্রকৃতিকন্যা সুন্দরবন ও সুন্দরববনের মধু সম্পর্কে।

সুন্দরববন

সুন্দরবন হচ্ছে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় অবস্থিত পৃথিবীর একমাত্র বৃহত্তম প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বন।  এ বন বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে অবস্থিত। সুন্দরবনের মোট আয়তন ১০০০০ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে আমাদের দেশের মধ্যের অংশের আয়তন প্রায় ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার।  বর্তমানে মোট ভূমির আয়তন ৪,১৪৩ বর্গ কিলোমিটার (বালুতট ৪২ বর্গ কি.মি. -এর আয়তনসহ) এবং নদী, খাঁড়ি ও খালসহ বাকি জলধারার আয়তন ১,৮৭৪ বর্গ কি.মি. ।
“সুন্দরবন”-এর আক্ষরিক অর্থ “সুন্দর জঙ্গল” বা “সুন্দর বনভূমি”। খুব সম্ভবত ‘সুন্দরবন’ নামটি সুন্দরী বৃক্ষের আধিক্যের কারণে (সুন্দরী-বন) অথবা সাগরের বন (সমুদ্র-বন) এখান থেকে এসেছে। সাধারণভাবে গৃহীত ব্যাখ্যাটি হলো এখানকার প্রধান উদ্ভিদ সুন্দরী বৃক্ষের (Heritiera fomes) নাম থেকেই এ বনভূমির নামকরণ।

সুন্দরববনের জীববৈচিত্র

জীববৈচিত্রের আধার এই সুন্দরবন। এখানে পাওয়া যাওয়া গাছের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সুন্দরী, গেওয়া, গরান এবং কেওড়া গাছ। উল্লেখযোগ্য বন্যপ্রাণীর মধ্যে শুরু হল রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, বানর, শুকর, কুমির, ডলফিন, গুইসাপ, অজগর, হরিয়াল, বালিহাঁস, গাংচিল, বক, মদনটাক, মরালিহাঁস, চখা, ঈগল, চিল মাছরাঙা ইত্যাদি। এ বন দেশের মৎস্য সম্পদেরও এক বিরাট আধার। ইলিশ, লইট্টা, ছুরি, পোয়া,  রূপচাঁদা, ভেটকি, পারসে, গলদা, বাগদা, চিতরা ইত্যাদি মাছ পাওয়া যায়। এছাড়া এ বনের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত প্রধান প্রধান নদীগুলো হলো- পশুর, শিবসা, বলেশ্বর, রায়মংগল ইত্যাদি। তাছাড়া শত শত খাল এ বনের মধ্যে জালের মতো ছড়িয়ে আছে।
এখানে বলতে হয় যে, বিশ্ব ঐতিহ্যে সুন্দরবন জায়গা করে নিয়েছে। ১৯৯২ সালের ২১শে মে সুন্দরবন রামসার স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সুন্দরবন ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্বের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
সুন্দরবনের জনসংখ্যার বেশির ভাগই স্থায়ী নয়। এ বন দেশের বনজ সম্পদের সবচেয়ে বড় উৎস। কাঠের উপর নির্ভরশীল সকল শিল্পের কাঁচামাল জোগান দেয় এই বন। এছাড়া এ বন থেকে নিয়মিত ব্যাপকভাবে আহরণ করা হয় ঘর ছাওয়ার পাতা, মধু, মৌচাকের মোম, মাছ, কাঁকড়া এবং শামুক-ঝিনুক।

সুন্দরববনের মধু

দেশে মধু উৎপাদনের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে সুন্দরবন। ১৮৬০ সাল থেকে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করা হয়। বনসংলগ্ন একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী বংশপরম্পরায় মধু সংগ্রহ করে। এদেরকেই মৌয়াল বলা হয়। দেশে উৎপাদিত  মোট মধুর ২০% সুন্দরবনে পাওয়া যায়। সুন্দরবনের সবচেয়ে ভালো মানের মধু খোলসী ফুলের ‘পদ্ম মধু’। মানের দিক থেকে এরপরেই গরান ও গর্জন ফুলের ‘বালিহার মধু’। মৌসুমের একেবারে শেষে আসা কেওড়া ও গেওয়া ফুলের মধু অপেক্ষাকৃত কম সুস্বাদু।
মধু সংগ্রহের জন্য প্রতিবছরের ১ এপ্রিল থেকে তিন মাসের (এপ্রিল, মে ও জুন) জন্য বন বিভাগ মৌয়ালদের অনুমতিপত্র (পাস) দেয়। আর সময় নষ্ট না করে শুরুর দিন থেকেই মধু সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মৌয়ালরা।
মধু সংগ্রহ করতে যাওয়ার আগে বিশেষ প্রার্থনা করে নেন মৌয়ালরা ৷  কারণ সেখানে বাঘের ভয়ের পাশাপাশি আছে ডাকাতের ভয় ৷ কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যান৷ মধু সংগ্রহের কিছু নিয়মনীতি ঠিক করে দিয়েছে বন বিভাগ, যেমন- মৌচাক থেকে মৌমাছি সরানোর সময় আগুনের ধোঁয়া ব্যবহার করতে হবে – এরকম নিয়ম আছে৷
মৌয়ালরা এখন সনাতন পদ্ধতির পাশাপাশি হাইজেনিক পদ্ধতিতেও সুন্দরবন থেকে মধু ও মোম সংগ্রহ করছে। যার ফলে মধু ও মোম সংগ্রহের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে । পরিচ্ছন্নভাবে মধু সংগ্রহ এবং এর গুণগত মানও বজায় রাখার জন্য বেসরকারি সংগঠনগুলো মৌয়ালদের যন্ত্রপাতি বিতরণ করছে।
মধু নিয়ে এত কথা হচ্ছে, আপনি জানেন মধু কী ?  মধু হচ্ছে একটি তরল আঠালো মিষ্টি জাতীয় পদার্থ, যা মৌমাছিরা ফুল থেকে পুষ্পরস হিসেবে সংগ্রহ করে মৌচাকে জমা রাখে । পরবর্তীতে জমাকৃত পুষ্পরস প্রাকৃতিক নিয়মেই মৌমাছি বিশেষ প্রক্রিয়ায় পূর্ণাঙ্গ মধুতে রূপান্তর এবং কোষবদ্ধ অবস্থায় মৌচাকে সংরক্ষণ করে । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে মধু হচ্ছে এমন একটি মিষ্টি জাতীয় পদার্থ যা মৌমাছিরা ফুলের পুষ্পরস অথবা জীবন্ত গাছপালার নির্গত রস থেকে সংগ্রহ করে মধুতে রূপান্তর করে এবং সুনির্দিষ্ট কিছু উপাদান যোগ করে মৌচাকে সংরক্ষণ করে।
কেন সুন্দরববনের মধু এত গুরুত্বপূর্ণ?  একারণ হিসেবে বলা যায় – মধু শক্তি প্রদায়ী, হজমে সহায়তা, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, ফুসফুসের যাবতীয় রোগ ও শ্বাসকষ্ট নিরাময়ে করে। মধুতে রয়েছে ভিটামিন যা  অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে কাজ করে। মধুতে প্রায় ৪৫টি খাদ্য উপাদান থাকে।
মধুর এত গুণ থাকা পরেও বাজারের মধু খাঁটি কিনা আপনি জানেন কি? অনেকেই বলবেন, না। খাবারের তালিকাভুক্ত ৪৩ ধরনের পণ্যে শতকরা ৪০ ভাগ ভেজালের সন্ধান পেয়েছে জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট (আইপিএইচ) এবং এর মধ্যে ১৩টি পণ্যে ভেজালের হার প্রায় শতভাগ।
প্রশ্ন করতে পারেন, খাঁটি মধু তবে কি পাওয়া যাবে না ? উত্তরে বলব, হ্যাঁ পাওয়া যাবে। বর্তমানে সুন্দরবন থেকে হাইজেনিক পদ্ধতিতে মধু আহরণ করা হয়, যা খাঁটি এবং সেই সাথে khaasfood.com থেকে খাঁটি সুন্দরববনের মধু পাবেন। 

Follow Us @VisitSundaebon